বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ১২:৩৩ অপরাহ্ন
আবুজার বাবলা, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার):
২০১৮ সালে শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা বাগানে ২ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যেকার একটি বিরোধ গ্রাম আদালতে নিম্পত্তি হয়। এক জনের ছাগল অন্যজন জবাই করে খায়। ছাগলের মালিক গ্রাম আদালতে মামলা দিয়ে ৪ দিনের মাথায় পেয়ে যান উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের রায়। এজন্য তার খরচ হয় ১০ টাকা, আর সময় লাগে মাত্র ৪দিন। আলোচিত এই মামলার রায় গোটা জেলায় গ্রাম আদালত সম্পর্কে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করে।
জানা গেছে, উপজেলার রাজঘাট ইউনিয়নের ওই চা বাগানের প্রত্যান্ত একটি গ্রাম মংরাবস্তী। আদিবাসী ও খৃষ্টান মিলে এখানে প্রায় ৩২০টি পরিবারের বাস। এই গ্রামের এক চা শ্রমিক লক্ষীন্দ্র সাঁওতাল (৬০)। বাগান শ্রমিক স্ত্রী ও ২ কন্যা সন্তানসহ ৪ জনের সংসার। আরো এক কন্যার বিয়ে দিয়েছেন। নিজের কোন জমি-জিরাত নেই।
কোম্পানির ১০৫ শতাংশ জমি লিজ নিয়ে এক ফসলি আমন চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সেচের অভাবে সে জমিতে অন্য কোন ফসল হয়না। জমি থেকে বছরে প্রায় ২০ মণের মত ধান আর চা বাগানের কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোন মতে সংসার চলে। ছোট মেয়ে দুটি মাঝে মাঝে চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সংসারে সাহায্য করে। সব মিলে সুখ-দুখের ছোট সংসার।
একদিন স্ত্রী সাথে পরামর্শ করে লক্ষীন্দ্রর ১ হাজার ৭’ টাকায় ১টি ছাগল কিনে আনেন। প্রায় দিন সে কাজে যাওয়ার সময় ছাগলটা মাঠে ছেড়ে দিয়ে কাজে যায় আবার বিকেলে কাজ থেকে ফিরে এসে ছাগলটা ঘরে এনে রাখেন। ৭/৮ মাস পর একদিন কাজ থেকে ফিরে এসে দেখে ছাগলটা বাড়ী ফিরেনি। অনেক খোঁজাখুজি করেও ছাগল আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এক পর্যায়ে লক্ষীন্দ্রর জানতে পারেন গ্রামের বিজলাল খাড়িয়া নামে আদিবাসী এক ব্যক্তির জমির ধান খেয়ে ফেলায় সে ছাগলটি নিয়ে গেছে। খাড়িয়াও ১২০ শতাংশ জমি লিজ নিয়ে ধান চাষ ও লেবু বাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্ত্রী চা শ্রমিক। সংসারে এক প্রতিবন্ধী মেয়ে ও দুই ছেলে। বিজলাল খড়িয়াও সহজ সরল মানুষ। সেদিন একটি ছাগল তার জমিতে ধান খেয়ে ফেলায় তিনি ছাগলটি ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে। কিন্তু ছাগলের মালিককে না পেয়ে ছাগলটি জবাই করে খেয়ে ফেলেন। এ কথা জানার পর লক্ষীন্দ্রর তো হতবাক। পরে লক্ষীন্দ্রর বিজলাল খাড়িয়ায় বিরুদ্ধে ওয়ার্ড সদস্য সুমন কুমার তাঁতীর কাছে নালিশ করে। পরে তার পরামর্শে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের স্বরনাপন্ন হন।
২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর লক্ষীন্দ্রর ১০ টাকা ফি দিয়ে বিজলাল খাড়িয়ার বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে গ্রাম আদালতে একটি ফৌজদারী মামলা দায়ের করেন। যার নং ২৮/২০১৮। ইউপি চেয়ারম্যান বিজয় বুনার্জী ১৫ অক্টোবর তারিখে উভয় পক্ষকে হাজির হওয়ার সমন জারি করেন। নির্ধারিত দিনে পক্ষদ্বয় হাজির হন। মামলার কার্যক্রম চলাকালে বিজলাল খাড়িয়া দোষ স্বীকার করলে চেয়ারম্যান ছাগলটির প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করে খাড়িয়ার বিরুদ্ধে লক্ষীন্দ্ররের অনূকুলে আড়াই হাজার টাকা পরিশোধের রায় দেন। অভিযোগ দায়েরের ৪ দিনের মাথায় দেয়া এই রায় উভয় পক্ষ মেনে নিয়ে একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকার একটি আপোষনামাতেও স্বাক্ষর করেন।
গ্রাম আদালতকে কেন্দ্র করে এভাবে বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক মানুষ বিরোধ নিম্পত্তি করে নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতির আপোষনামায় নাম স্বাক্ষর করছেন।
বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার সর্বনি¤œ স্তর গ্রাম আদালতের এই রায় এখানকার গ্রামীন বিচার ব্যবস্থায় একটি মাইল ফলক হিসেবে দেখা হয়। জানা গেছে, সুবিধা বঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিচারব্যবস্থা সহজ করতে স্থানীয় সরকার বিভাগ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউএনডিপি’র যৌথ অর্থায়নে “বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (২য় পর্যায়) প্রকল্প” বাস্তবায়ন করছে। দেশের ২৭টি জেলার ১২৮টি উপজেলার ১,০৮০টি ইউনিয়নে ৪ বছর মেয়াদী (২০১৬-২০১৯) এ প্রকল্প” বাস্তবায়ন করছে। দাতা সংস্থার আর্থিক ও কারিগরী সহায়তায় স্থানীয় সরকার বিভাগের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) মৌলভীবাজার জেলায় ৪টি উপজেলার ৪১টি ইউনিয়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে।
গ্রামাঞ্চলের ছোট খাট বিরোধ নিষ্পত্তি ও বিচার ব্যবস্থা সহজলভ্য করার উদ্দেশে গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গ্রাম আদালত কার্যক্রম দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব, অসহায়, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি জনগনের আর্শিবাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ নিয়ে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে।
লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস (ব্লাস্ট) এর এ্যকটিভ ভিলেজ কোর্ট অব বাংলাদেশ প্রকল্পের শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ উপজেলা সমন্বয়কারী তাহমিনা পারভিন জানান, ‘আমরা মৌলভীবাজারে গ্রাম আদালত নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি প্রান্তিক মানুষের মধ্যে অনেক আগ্রহ। ছোট-খাট বিরোধ সহজ এবং দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য গ্রাম আদালত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্রাম আদালতের দিকে এখন অনেকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। তাহমিনা পারভিন দীর্ঘদিন থেকে কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে গ্রাম আদালত নিয়ে কাজ করছেন। উপজেলা দুটির সবগুলো ইউনিয়নে নিয়োজিত সহকারীদের নিয়ে গ্রাম আদালতের বিষয়টি সমন্বয় করছেন।
তিনি এনিয়ে গ্রামীণ জনগনের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে গ্রামে গ্রামে ওরিয়েন্টেশন, উঠান বৈঠক, কমিউনিটি মতবিনিময় সভা, ভিডিও শো ও র্যালির মাধ্যমে বিভিন্ন সচেতনতামুলক কাজে অংশগ্রহন করছেন। এতে করে গ্রাম আদালত সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ‘মামলা ভীতি’ দূর হচ্ছে। ফলে প্রান্তিক গরীব মানুষরে জন্য সহজে বিচার চাওয়া ও পাওয়ার পথ সুগম হয়েছে।
গ্রাম আদলত সম্পর্কে তাহমিনা পারভীন জানান, ‘১৯৭৬ সালে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য একটি আইনসম্মত আদালত প্রতিষ্ঠা ও তৃণমূল পর্যায়ে দক্ষতা সম্পন্ন, অপেক্ষাকৃত আনুষ্ঠানিক ও ক্ষমতাশীল এই বিচার ব্যবস্থা চালু হয়। ৯০ থেকে ১২০ দিনের বিচারকার্যে ও সময়সীমা নিয়ে গঠিত গ্রাম আদালতে জরিমানা বা ক্ষতিপূরণের মূল্যমান প্রথমে ৫ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হলেও ২০০৬ সালের মে মাসে ১৯ নম্বর আইনের অধীনে ১৯৭৬ সালের গ্রাম আদালত অধ্যাদেশের সাথে সমন্বয় করে ২৫ হাজার এবং সর্বশেষ ২০১৩ সংশোধনিতে ৭৫ হাজার টাকায় উন্নীত করে ২০১৬ তে বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে’।
‘এখানে পেশাদার আইনজীবী নিয়োগের বিধান নেই। পক্ষপাত বা বিলম্ব বিচার বা বিচারহীনতার কোন সুযোগ নেই। ফলে অসংখ্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহজে বিচার প্রাপ্তি এবং বিভিন্ন থানা আদালতে মামলাজট কমাতে গ্রাম আদালত ব্যাপক ভূমিকা রাখছে’ বলে তিনি জানান।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জেলার শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, বড়লেখা ও কুলাউড়া উপজেলার ৪১ টি ইউনিয়নে গ্রাম আদালতে ৬ হাজার ২শ’ ৫১টি মামলা রুজু হয়েছে। নিস্পত্তি হয়েছে ৫হাজার ৯শ’ ৮৬ টি এবং ক্ষতিপুরণ আদায় হয়েছে ২ কোটি ৫৮ লক্ষ ২৩ হাজার ৯শ’ ৮৭ টাকা। এর মধ্যে ২৫৬ টি মামলা নিস্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।