বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ০১:৪৮ পূর্বাহ্ন
করাঙ্গীনিউজ: সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ড ১১ বছরের বেশি সময় পর গত ১৩ জুন চা-বাগান শিল্প সেক্টরে শ্রমিকদের জন্য ‘এ’ ক্লাস বাগানে দৈনিক ১২০ টাকা, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্লাস বাগানে যথাক্রমে ১১৮ টাকা ও ১১৭ টাকা মজুরির প্রস্তাব করে বিভিন্ন সুপারিশ গেজেট আকারে প্রকাশ করেন। মজুরি বোর্ডের সুপারিশ প্রত্যাখান করে চা-শ্রমিক সংঘের উদ্যোগে ২০ জুন বেলা ১২ টার সময় শমসেরনগরস্থ অস্থায়ী কার্যালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির আহবায়ক রাজদেও কৈরীর সভাপতিত্বে ও যুগ্ম-আহবায়ক হরিনারায়ন হাজরার পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি কবি শহীদ সাগ্নিক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস, চা-শ্রমিক যুব সংঘের সাধারণ সম্পাদক স্বপন নায়েক, রাজনগর চা-বাগানের নেতা নারায়ন গোড়াইত, আলীনগর চা-বাগানের রামাকান্ত কৈরী, সুনছড়া চা-বাগানের কাজল হাজরা, ডবলছড়া চা-বাগানের বাবুল রাজভর, লংলা বাগানের সন্যাসী নাইড়–, চাতলাপুর চা-বাগানের নারায়ন নায়েক, চা-শ্রমিকনেতা সুনীল কর, মধু রজক, দোলন অলমিক, হেমরাম লোহার, গোপাল দাস, রমেশ কানু, সত্য পাশী প্রমূখ।
সভায় এক প্রস্তাবে গত ২৮ মে রাতে সুনছড়া চা-বাগানে ম্যানেজারের মদদপুষ্ট বহিরাগত সন্ত্রাসীরা হরিনারায়ন হাজরা, স্বপন নায়েকসহ চা-শ্রমিকদের উপর হামলা এবং বাড়িঘরে ভাংচুর, গবাদিপশু ও অর্থ লুটপাটের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্থদের উপযুক্ত ক্ষতিপুরণ ও গবাদিপশু উদ্ধার এবং চাকরীতে পুনঃবহালের দাবি জানান।
সভায় বক্তারা বলেন প্রতি ০৫ বছর অন্তর মজুরি বোর্ড গঠন করার আইন থাকলেও ২০০৯ সালের প্রায় ১১ পর ২০১৯ সালে চা-বাগান শিল্প সেক্টরের জন্য নি¤œতম মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। বাংলাদেশ শ্রমআইন-২০০৬ এর ১৩৯(২) ধারা মোতাবেক ৬ মাসের মধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠানোর আইন থাকলেও বোর্ড গঠনের দেড় বছরের বেশি সময় পর নি¤œতম মজুরির খসড়া সুপারিশ গত ১৩ জুন ২০২১ তারিখে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। বক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন চা-শিল্পের ১৬৭ বছরের ইতিহাসেও চা-শ্রমিকদের মজুরি ১৬৭ টাকাও হয়নি। অথচ শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গার পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে চা-উৎপাদনে বাংলাদেশ ৯ম স্থানে উঠে এসেছে। এমনকি করোনাকালে বিভিন্ন শিল্পের শ্রমিকরা ছুটি এবং নানা রকম প্রণোদনা পেলেও চা-শ্রমিক উৎপাদনে সক্রিয় থাকায় ২০২০ সালেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ কোটি ৪ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা উৎপাদন বেশি হয়। অথচ এর বিনিময়ে মালিকদের মুনাফা এবং বাবু-সাহেবদের সুযোগ-সুবিধা বাড়লেও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্দ্ধগতির এই সময়ে শ্রমিকদেরকে দেওয়া হয় মাত্র দৈনিক ১২০ টাকা। বাংলাদেশে শিল্প সেক্টরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি পেয়ে থাকেন চা-শ্রমিকরা। নিন্মতম মজুরি বোর্ড কর্তৃক ঘোষিত ৪৩ টি সেক্টরে এবং মজুরি কমিশন ঘোষিত রাষ্ট্রায়াত্ব শিল্প সেক্টরের মজুরির সাথে তুলনা করলে চা-শ্রমিকদের মজুরি অত্যন্ত কম। উপরন্তু মজুরি বোর্ড তাদের সুপারিশে চা-শিল্পের প্রচলিত প্রথা দ্বি-বার্ষিক চুক্তিকে আগামীতে ত্রি-বার্ষিক করার সুপারিশ করেছে। বিস্ময়কর বিষয় যে ঠিকা শ্রমিকরা যেখানে বর্তমানে ১২০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন সেখানে মজুরি বোর্ড প্রস্তাব করেছে ১১০ টাকা।
বাংলাদেশ শ্রমআইন-২০০৬ এর ৫৮ ধারায় বিশুদ্ধ পানীয় জলের কথা বলা হলেও মজুরি বোর্ড শ্রমিকদের পানীয় জলের জন্য কূয়ার ব্যবস্থা, শ্রমআইনের সাথে সাংঘর্ষিকভাবে গ্র্যাচুইটি ও কোম্পানীর লভ্যাংশ হতে শ্রমিকদের বঞ্চিত করার মতো সুপারিশও করেছে।
একজন শ্রমিকের দৈনিক পরিশ্রমের পর পরবর্তি দিন কাজে যোগদানের জন্য শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজনে দৈনিক তিন বেলা অতি সাধারণভাবে আহারের জন্য ১০০(২০+৪০+৪০) টাকা দিলেও পেট ভরে না। তাই স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ মা-বাবাকে নিয়ে ৬ সদস্যের এক পরিবারের জন্য দৈনিক ন্যূনতম ৬০০ টাকা দরকার। এর সাথে অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচযুক্ত করলে মাসিক ২০,০০০ টাকা ছাড়া কোনভাবেই বর্তমান অগ্নিমূল্যের বাজারে কোন ভাবেই চলা সম্ভব নয়। তদোপুরি প্রতিবেশি দেশসমূহের চা-শ্রমিকদের মজুরির সাথে তুলনা করলে আমাদের দেশের চা-শ্রমিকদের মজুরি অত্যন্ত্য কম। ২০১১ সালে শ্রমমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন দৈনিক ১৫০ টাকা, ২০১৪ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ মহসীন আলী ২০০ টাকা দৈনিক মজুরি হওয়ার কথা বলেছিলেন, আর ২০২০ সালে সংসদে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ এলাকার সংসদ সদস্য উপাধক্ষ ড. আব্দুশ শহীদ চা-শ্রমিকদের মজুরি কমপক্ষে ৫০০ টাকা করার জন্য বক্তব্য দেন। প্রতিবেশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চা-শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক ২০২ রূপি(২৩৫ টাকা), আসামে দৈনিক ২১৭ রুপি(২৫১ টাকা), কেরালায় বেসিক ৩৮০ টাকা যা সাকুল্যে দৈনিক ৬০০ রুপি(৬৯৪ টাকা), শ্রীলঙ্কায় দৈনিক ১০০০ রুপি( ৪৬০.৪০ টাকা), নেপালে দৈনিক ২৭৮ রুপি(১৯৮ টাকা), কেনিয়ায় মাসিক ১৫,৯৫০ শিলিং(১২৪৬৯ টাকা) থেকে ৫৩,৮৯৭ শিলিং(৪২১৩৩ টাকা), শীর্ষ চা উৎপাদনকারী দেশ চীনের শ্রমিকদের প্রদেশ ভিত্তিক নি¤ন্মতম মজুরি ঘন্টা প্রতি ১৮.৪ থেকে ২৪ ইউয়ান(২৩৩ থেকে ৩০৫ টাকা)। অথচ আমাদের দেশের সরকার কথায় কথায় উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে বলে থাকেন বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকে প্রতিবেশিদের থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। সরকারি তথ্য মতে দেশে রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, মাথাপিছু আয় ২,০৬৪ ডলার(১,৭৫,৫২৪ টাকা); সেখানে চা-শ্রমিকদের সর্বোচ্চ আয় মাসিক ৩,৬০০ টাকা হিসেবে বার্ষিক মাত্র ৪৩,২০০ টাকা।
এমতবস্থায় সরকার গঠিত নিস্মতম মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে বর্তমান বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণভাবে ৬/৭ জনের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য দৈনিক ৬৭০ টাকা মজুরিসহ চা-শিল্পে নৈমিত্তিক ছুটি(বছরে ১০ দিন) কার্যকর ও অর্জিত ছুটি প্রদানে বৈষম্যসহ শ্রম আইনের বৈষম্য নিরসন করে গণতান্ত্রিক শ্রমআইন প্রণয়ন এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মজুরি ও উৎসব বোনাস প্রদানে সকল অনিয়ম বন্ধ করে শ্রমআইন মোতাবেক নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক প্রদান এবং ৯০ দিন কাজ করলেই সকল শ্রমিককে স্থায়ী করার বিষয় যুক্ত করে চুড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করার দাবি জানান। সভা থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লিখিতভাবে মজুরি বোর্ড বরাবর মজুরি বোর্ডের সুপারিশের প্রেক্ষিতে আপত্তি ও ১২ টি বিষয়ে সুনির্দ্দিষ্ট প্রস্তবণা পেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।