মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ০৩:৩৩ পূর্বাহ্ন
বাহুবল (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি:
হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) ও কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) সংস্কার কর্মসূচির অধীন বাস্তবায়িত প্রকল্প নিয়ে চলছে নয়ছয়। উঠেছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। যেসব প্রকল্প নেয়া হয়, সেগুলোর বেশিরভাগেই এক তৃতীয়াংশের কাজ হয় না। কাজ হয় নামে। আর কিছু কিছু প্রকল্প আছে কাগজে। বাস্তবে কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রকল্পে রাস্তায় মাটি দ্বারা উন্নয়নের কথা বলা হলেও কিছু কিছু রাস্তায় এক টুকরি মাটিও ফেলা হয়নি। এভাবে বেশিরভাগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে শুধু কাগজের দলিলে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এসব সচিত্র তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতি অর্থ-বছরে টিআর ও কাবিটা-কাবিখা সংস্কার কর্মসূচির অধীন গ্রামীণ পর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাহুবল উপজেলায় বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা ও খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয় সরকার। এসব বরাদ্দে সংশিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। কাজের তদারকি করেন সংশিষ্ট উপজেলা প্রশাসন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা। কিন্তু তদারককারী ও বাস্তবায়নকারীদের গড়িমসি তদারকির ঘাটতির কারণেই প্রকল্পের টাকা চলে যায় সভাপতি সেক্রেটারীর পকেটে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তারাই দায়ী বলে মন্তব্য করেন সচেতন মহল। ফলে শেষমেশ কাজ হয় নামে। এসবের সত্যতা সঠিক তদন্তে বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন স্থানীয়সহ বিভিন্ন মহল।
এসব প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে কথা বললে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ তাজ উদ্দিন বলেন-প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে করতেই হবে। অন্যথায় বিল পাবেন না। বিভিন্ন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও অর্ধেক বা সিকিভাগ এবং কোথাও কাজ না করেই বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রকল্পের কমিটির লোকজন। প্রকল্পের কাজে তদারকির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারাও এই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত বলে অভিযোগ অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
নির্বাচনী এলাকা ভিত্তিক বাহুবল উপজেলায় ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ টিআর খাতে ২য় পর্যায়ে ১৮ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকার ২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন করা হয়। যার প্রকল্প তালিকার ডিও দিয়েছিলেন তৎকালীন এমপি গাজী মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ।
দেখা গেছে, কোন কোন প্রকল্পের পুরো টাকাই ভাগ বাটোয়ারা করে পকেটে চলে গেছে। কিছু কিছু রাস্তায় মাটি ভরাটের নামে এক টুকরি মাটিও ফেলা হয়নি। অথচ কাজের আগেই ৫০% বিল দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যেখানে কাজই হয়নি সেখানে ওই পরিশোধিত সরকারি টাকার কি হবে? এমন প্রশ্নও সচেতন ব্যক্তিবর্গের। এর মাঝে ‘খাগাউড়া গ্রামের আওলাদ মিয়ার বাড়ি হতে নোয়াহাটি জামে মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা মাটি দ্বারা উন্নয়ন’ এই প্রকল্পের কোন কাজই হয়নি। প্রকল্প গ্রহণের মাস দুয়েক আগে এলাকাবাসী চাঁদা তুলে কিছু মাটি রাস্তায় ফেলেন এবং উপজেলা পরিষদ থেকে ইট সলিংও করে দেয়া হয়। কিন্তু এই রাস্তায় দুই মাস পর টিআর প্রকল্প গ্রহণ করে চুরি আত্মসাতের উদ্দেশ্য নয়কি?
এলাকার কাছন মিয়া জানান, রাস্তাটি আমরা এলাকাবাসী চাঁদা তুলে করেছি এবং উপজেলা পরিষদ ইট সলিং করেছে। এখন টিআর প্রকল্প হয়েছে বলে আমরা জানি না। একই কথা বলেন আওলাদ মিয়াও।
এভাবে ‘তিতারকোনা গ্রামের আওয়াল মিয়ার বাড়ি হতে তুরাব মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মাটি দ্বারা উন্নয়ন’, পশ্চিম জয়পুর গ্রামের নওশাদ মিয়ার বাড়ি হতে সাইফুল মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মাটি দ্বারা উন্নয়ন, বিশ্বরোড হতে শেওড়াতুলী নছরত উল্লার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মাটি দ্বারা উন্নয়ন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের আলামত নেই।
সরেজিমন দেখা গেছে, এমন জায়গায় প্রকল্প ধরা হয়েছে যেখানে প্রয়োজনই ছিল না। চলিতাতলা রোড হতে উজিরপুর সুরত আলীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা ইট সলিংকরণ। মাত্র কয়েক ফুট সলিং করেই ৫২ হাজার শেষ। ‘বৃন্দাবন চা বাগান শ্মশানঘাট উন্নয়ন’ এই প্রকল্পের উন্নয়নের কোন আলামতই নেই। শ্মশানঘাটও খেয়ে শেষ। সামান্য কয়েকটি তাল গাছ রোপন করেই তাল গাছ রোপন প্রকল্পের টাকা শেষ। স্কুল মেরামত করার নামে প্রকল্পের টাকা উত্তোলন করা হলেও প্রধান শিক্ষকই জানেন না কিছু। কাজ তো দূরের কথা।
আর যেসব প্রকল্প কাজ করা হয়েছে তাও অর্ধেক এবং সিকিভাগ করেই সব জায়েজ করে নিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তাজ উদ্দিন অনিয়মের কারণে বিল দেবেন না বললেও অনেক বিলই দেয়া হয়েছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও অফিস সূত্রে জানা গেছে। তবে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবও একটি কারণ বলে অনেকে মনে করেন।
এদিকে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কাবিটা কর্মসূচীর আওতায় নির্বাচনী এলাকা ভিত্তিক ৩য় পর্যায়ে বাহুবল উপজেলার অনুকুলে ২৬ লক্ষ টাকার ২০টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। এই প্রকল্পের ডিও দেন এমপি আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী। দেড় মাস আগে থেকেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু প্রকল্প সভাপতি নিয়মানুযায়ী কাজের আগেই অর্ধেক বিল উত্তোলন করলেও কাজই শুরু করেননি অনেক জায়গায়। কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও অনেকগুলোতেই অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে যেগুলো রাস্তায় মাটি দ্বারা উন্নয়ন সেগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। নাম মাত্র মাটির প্রলেপ দিয়েই কাজ শেষ করে ফেলেন সভাপতি। এই অনিয়মের মাঝে চুড়ান্ত বিলও উত্তোলন করে নিয়েছেন কয়েকজন।
এর মাঝে ‘মুদাহরপুর এলজিইডি রাস্তা হইতে নোয়াঐ মাওঃ শফিক মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় মাটি ভরাট। এর বরাদ্দের পরিমাণ ২ লক্ষ টাকা। রাস্তায় মাটি ফেলার কয়েকদিনের মধ্যেই বৃষ্টিতে সমুদয় মাটি ধসে খাদে চলে গেছে এবং মূল রাস্তা দৃশ্যমান হয়েছে। মনে হয়েছে যেন, সরকারের দুই লক্ষ টাকাই জলে ফেলা হয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় মাটির প্রলেপ ছাড়া কিছু নয়। এর জন্য দায়ী সভাপতিসহ সংশ্লিষ্টরা।
দেখা গেছে, রাস্তাটি পূর্বে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায়ই এখন বিদ্যমান, যা ছবিতে সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে। আশ্রয়ন প্রকল্পের রাস্তা ও মহিবুল হাসানের বাড়ি হতে খাগাউড়া মাঠ পর্যন্ত মাটি ভরাট’, শোকর গোজার বিদ্যালয়ের নতুন ঘর নির্মাণ পূর্বক ভিটে মাটি দ্বারা ভরাট’, প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি। স্নানঘাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাস্তা হইতে হাওরমুখী কাকৈ বিল পর্যন্ত রাস্তায় মাটি ভরাট’ দেড় লক্ষ টাকার বরাদ্দের প্রকল্পে চরম অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। পূর্বজয়পুর এলজিইডি রাস্তা হইতে মুক্তিযোদ্ধা তৈয়ব খানের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় মাটি ভরাট’, এই প্রকল্পের বরাদ্দ ১ লক্ষ টাকা হলেও রাস্তায় কাজ করা হয়েছে মাটির প্রলেপ দিয়ে। মাত্র কয়েকজন শ্রমিক কোদাল দিয়ে জমি থেকে রাস্তায় মাটি ফেলে দুইজন মাটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ। বড়জোর কয়েক হাজার টাকার কাজ হয়েছে। অবশিষ্ট টাকাই পকেটে যাওয়ার উপক্রম। কারণ এখন বর্ষাকাল। রাস্তায় আর মাটি ফেলার সুযোগ নেই।
মহব্বতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রাস্তায় মাটি দ্বারা উন্নয়ন ও গাইড ওয়াল নির্মাণ’ ২ লক্ষ টাকা বরাদ্দের অর্ধেক বিল প্রায় দেড় মাস আগেই উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু এলাকাবাসীর জানাজানির পর সভাপতি রাতারাতি করে কাজ শুরুর প্রস্ততি নিচ্ছেন। ভাটি অঞ্চল হিসেবে বর্তমানে বর্ষার পানিতে টইটুম্বুর। কিন্তু ৫০% বিল উত্তোলনের সময় কোন পানি ছিল না। এখন রাস্তা মেরামত কিভাবে করবেন? মাটি পাবেন কোথায়? পানির মাঝে গাইড ওয়াল কতটুকু টেকসই হবে? এসব প্রশ্ন এলাকাবাসীর। এই কাজে চরম অনিয়মের আশংকা করছেন এলাকাবাসী। ‘
সোয়াইয়া বাজার হইতে সোয়াইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন রাস্তা নির্মাণ ও গাইড ওয়াল নির্মাণ’ প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়। বিশাল পুকুরের উপর দিয়ে মাটি ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করতে হবে। যা আদৌ সম্ভব নয় এই বরাদ্দে। তাহলে বরাদ্দের টাকা কোথায় কি করবেন? প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এলাকাবাসী জানতে চায়। ৩য় পর্যায়ের এই কাজের অনিয়মের দায় সংসদ সদস্যের না হলেও যারা কাজ করেছেন তারা স্থানীয় সংসদ সদস্যের বিশ্বাসে আঘাত করেছেন বলে মনে করেন অনেকে। কিন্তু এর দায় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এড়াতে পারেন কি? উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ তাজ উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি প্রকল্পের কাজ শক্ত তদারকি করবেন বলে এ প্রতিনিধিকে আশ্বস্ত করেন। জানা যায়, তিনি নবীগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন।
অন্যদিকে উপজেলা ওয়ারী টিআর কাবিখা কাবিটাও নামমাত্র কাজ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান তার অংশে প্রাপ্ত অনেক বরাদ্দই অর্থ সুবিধার বিনিময়ে নিজের পছন্দের প্রকল্প সভাপতি করে নয়ছয় করেছেন। যত কথাই বলা হোক না কেন, প্রবাদ আছে ‘শুটকির নৌকায় বিরাল পাহারাদার’ হলে এমন হবেই।
সাধারণ কথা হচ্ছে, পাহারাদার থাকতে যদি চুরি হয়, তাহলে পাহারাদার নিশ্চিত চুরিতে জড়িত বা পাহারাদারের গাফিলতি আছে। পাহারাদারের গাফিলতি অমার্জনীয় হিসেবেই স্বীকৃত। কারণ প্রকল্পের টাকা আত্মসাত করা আর চুরি করা সমান অপরাধ হিসেবেই গণ্য।