বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ০৫:৪০ অপরাহ্ন
কামরুল হাসান: আজ ১৮ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার কৃষ্ণপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে ১২৭ জন নিরিহ মানুষকে একসাথে পাকহানাদার বাহিনী হত্যা করেছিল। এত লাশ এক সাথে দাফন কিংবা সৎকারের কোন ব্যবস্থা না থাকায় নদী দিয়ে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। প্রতি বছর এদিনটি নিরবেই কেটে যায়। সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা স্মরণ হলে আজও অনেকেই ক্ষেপে উঠেন।
লাখাই উপজেলার ১নং লাখাই ইউনিয়নের কৃঞ্চপুর গ্রাম। জেলার শেষ প্রান্ত ও ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার মধ্যবর্তী নাসিরনগর উপজেলারও শেষ সীমানায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভাটি এলাকার কৃষ্ণপুর। যোগাযোগের তেমন ভাল মাধ্যম নেই। বর্ষায় নৌকা আর শীতকালে পায়ে হেটে চলাচল করতে হয়। এই গ্রামে শতকরা ৯৫ ভাগ লোকই শিক্ষিত ও শতভাগ লোক হিন্দুধর্মাবলী।
সরজমিনে স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কৃষ্ণপুর গ্রামটি প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় আশপাশের গ্রাম থেকে নিরিহ লোকজন পাকবাহিনীর ভয়ে কৃষ্ণপুর গ্রামের আশ্রয় নেয়। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় ১৮ সেপ্টেম্বর পাকহানাদার বাহিনী ভোর বেলায় কৃষ্ণপুর গ্রামে হঠাৎ আক্রমন চালায়। এসময় গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ গ্রামের একটি পুকুরের পানিতে ডুব দিয়ে নিজেকে আত্মরক্ষা করে। পুকুরটি আজও কালের স্বাক্ষী। কুচুরিফেনা আর ঝোঁপঝাড়ে ঢেকে আছে পুকুরটি। সেইদিন শতশত নারী-পুরুষ আত্মরক্ষা করলেও ১২৭ জনকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করে পাকবাহিনী।
আশিবছর বয়স্ক ঊষা রানী রায় বলেন, ছেলের বাবাকে ধরে নিয়ে প্রাইমারী স্কুলের কাছে গুলি করে মেরে ফেলে পাকিস্তানিরা। তখন আমার ছেলে অতুলের বয়স ১ বছর। আমিসহ বাড়ীর মহিলারা ভয়ে বাড়ী থেকে বের হইনি। চারদিকে গুলি শব্দ। গ্রামের অনেক যুবক পুরুষ মহিলারা আমাদের বাড়ীর পাশে কুচুরিফেনায় ভরপুর পুকুরে ডুব দিয়ে লুকিয়ে ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী অরবিন্দ্র দাশ বলেন, যুদ্ধের সময় বয়স ১৫ বছর। পাকিস্তানীরা নৌকা দিয়ে এসে গ্রামের চারদিক ঘিরে ফেলে। আশ্রয় নেয়া লোকদের একত্র করে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। আমরা কয়েকজন ভয়ে কাছে যেতে পারিনি দূর থেকে এসব দেখেছি।
স্থানীয় ওয়ার্ডের মেম্বার অতুল রায় বলেন, কৃষ্ণপুর হত্যা দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে যেস্থানে লাশের স্তুপ ছিল বর্তমানে চন্দিপুর বাজার ঘেষা বড় দিঘির পাড়ে ২০১৩ সালে বধ্যভূমি নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সরকারি, ব্যক্তি উদ্যোগ ও গ্রামবাসীর অর্থায়ণে এ পর্যন্ত ৩২ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এখনো বধ্যভূমি নির্মাণ কাজ চলমান। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য রেষ্টুরুম, ওয়াশরুম, খাবার পানির জন্য একটি গভীর নলকুল স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রতি বছর ১৮ সেপ্টেম্বর আসলেই গ্রামবাসীর উদ্যোগে বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। গ্রামবাসীর অর্থায়নে বধ্যভূমিতে ১২৭ জনের মধ্যে পরিচয় পাওয়া ৪৫ জনের নামে একটি স্মৃতিস্বম্ভ নির্মান করা হয়েছে। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের নাম সরকারি তালিকায় স্থান পায়নি।
বীরমুক্তিযোদ্ধা পুলিশের ওসি (অবঃ) অমলেন্দু লাল রায় জানান, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধের চেতনার সরকার। বর্তমান সরকারের আমলেও এখানকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কিংবা ১২৭ জনের মধ্যে পরিচয় পাওয়া ৪৫ জন ব্যক্তি আজও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি। এতে আমরা হতাশ।
উপজেলা প্রশাসনের সাথে যোগযোগ করা হলে জানা যায় প্রশাসনের দিক নির্দেশনায় স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি উদযাপন করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান ও আলোচনা সভা।