করাঙ্গী নিউজ
স্বাগতম করাঙ্গী নিউজ নিউজপোর্টালে। ১৫ বছর ধরে সফলতার সাথে নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করে আসছে করাঙ্গী নিউজ। দেশ বিদেশের সব খবর পেতে সাথে থাকুন আমাদের। বিজ্ঞাপন দেয়ার জন‌্য যোগাযোগ করুন ০১৮৫৫৫০৭২৩৪ নাম্বারে।

পলঙ্কয়ি ঝড়ের ভিতর পথ চলার ৫ বছর…

  • সংবাদ প্রকাশের সময়: শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০২২

সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ: ২০১৭ সালের জুলাই মাসে হঠাৎ আব্বার ক্যান্সার ধরা পরে। একমাত্র সন্তান হিসাবে চিকিৎসা ডাক্তার ও হাসপাতালকেই সঙ্গি করে ফেলতে হয় সেই থেকে টানা। সাথে এই ৫বছর চলতে থাকে জীবনের উপর দিয়ে একেরপর এক নানান ট্যাজিডি ও পলঙ্কয়ী ঝড়। আব্বার খেদমত করতে গিয়ে অনলাইন- অফলাইনসহ দুনিয়ার অনেক কিছু থেকেই আমি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। ১৮সালের মে মাস পর্যন্ত আব্বা বাড়িতে ছিলেন এবং লেখালেখি করতে পারতেন। এর পর ক্রমশ অসুস্থতা বাড়তে লাগলো।একমাত্র সন্তান হিসাবে চোখের সামনে বাবার কষ্ট সহ্য হচ্ছিল না। ঢাকায় নিয়ে আসি উন্নত চিকিৎসার জন্য।

এই সময়টায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় আমার তালিম ও তিজারার কার্যক্রম। মাদরাসায় পড়ানো এবং ব্যাবসা- বানিজ্য কিছুই সম্ভব হচ্ছিল না, এমন কী আল্লাহর রাস্তায় লম্বা সফরও। অনেক বড় ফার্মেসি ব্যাবসা ছিল। ১ বছর কর্মচারী দিয়ে ব্যাবসা চালানোর চেষ্টা করে, সর্বশেষ পানির দামে সেই ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দিতে হয়। আমি সব সময় মনে করি, মানুষের কাছে হাত পাতা থেকে হালাল রিজিকের জন্য সবোর্চ্চ চেষ্টা করা ঈমানের পর সর্বশেষ্ঠ এবাদত।

তখন কিছুদিনের জন্য তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ সাহেবের তত্বাবধানে ইফার একটি প্রকল্পে যোগ দান করি। শেখ আব্দুল্লাহ ছিলেন অমায়িক এক ব্যাক্তিত্ব। করোনার প্রথম ধাপেই আকস্মিক হঠাৎ তিনি ইন্তেকাল করেন। আমার এই কাজটিও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এর ভিতর আব্বার দুটি বড় ধরণের অপারেশন হয়। একবার মলধার কেটে কৃতিমভাবে প্রতিস্থাপন। আবার বাম কিডনী কেটে ফেলতে হয়। মৃত্যুর মুখ থেকে বাবা কুদরতীভাবে ফিরে আসেন।

পাশাপাশি শত ব্যাস্ততার ভিতর ২০১৮সালের জুলাই মাসে “মাসিক আত তাহকীক” নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করি। শুরুতে ৩০ হাজার টাকা কতৃপক্ষ মাসিক হাদিয়া নির্ধারণ করেন। পত্রিকাটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। কিন্তু তিন মাস পর মাসিক হাদিয়া বন্ধ হয়ে যায়। মি কাজ ঠিকই চালিয়ে যাই। করোনার কঠিন সময়ে পত্রিকাটি ৪মাস পুরোপুরি বন্ধ থাকে। করোনার পর অবৈতনিক পত্রিকাটি আরো দেড় বছর চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি নিজ উদ্যোগে। সর্বশেষে ২০২১সালে এটিও সরকারী রেজিষ্ট্রেশন না পেয়ে বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১সালের জুলাই মাসে আবার “মাসিক দ্বীনি দাওয়াত” নামে একটি দ্বীনী পত্রিকা বের করি। নানান সংকট ও ক্রমগত মাসিক নিয়মিত এখন পর্যন্ত পত্রিকাটির ধারাবাহিক প্রকাশনা আলহামদুলিল্লাহ অব্যাহৃত আছে।

এর ভিতর ২০১৮ সালে ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে ৫০ হাজার টাকা মাসিক বেতনে নির্বাহী সম্পাদক হিসাবে যোগদান করি। টানা দেড় বছর কাজ করে ৬ মাসের বেতন বাকী রেখে ইস্তেফা দিয়ে চলে আসি। এখনো সেই বুজুর্গ সম্পাদক থেকে আমার পাওনা টাকা আদায় করতে পারি নি। তখন নিয়ত করি আর কখনো অন্যের প্রতিষ্ঠানে কাজ করবো না। নিজে প্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থানের বাজার তৈরী করবো। কিন্তু আব্বার চিকিৎসার দৌড়াদৌড়িতে নিজে বড় ধরনের কিছু করার সুযোগ হয়ে উঠছিল না।

২০১৯সালের দিকে আবার ব্যাবসা শুরু করি। আমার লেখা ১১টি বই ও কয়েকটি অনুবাদ দিয়ে ঢাকায় নতুন করে মাকতাবায়ে ইলিয়াস নামে প্রকাশনা ব্যাবসা শুরু করি। লেখালেখি ও বাবার খেদমত এই দুটিকেই পেশা হিসাবে বেঁচে নেই। ব্যাপক মার্কেটিং থাকার পরেও করুনাকালে সেটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, প্রকাশনার লাখ লাখ টাকা সেসময় আব্বার চিকিৎসার কাজে ব্যায় করি।

এই সময়টিতে আব্বার খেদমত ও পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি “জাতীয় কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বাংলাদেশ ” এর কাজ করি,নিজে রাতদিন খেটে, বলতে গেলে একা দশজনের কাজ নিজে করে বোর্ডটিকে দাড় করানোর চেষ্টা করতে থাকি। তখন কয়েক বছরের কাজ মাত্র ১বছরে ৩২টি শিশু পাঠ্য বই, বোর্ডের বিভিন্ন কারিকুলম মৌলিকভাবে নিজেস্ব ও নতুন গবেষণামূলক একাধিক গ্রন্থ রচনা করি। প্রায় দশ হাজার পৃষ্ঠার মতো অনুবাদ ও কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থের কাজ শেষ করি। আব্বার খেদমতের বরকত ছিল এসব কাজ। যদি এসবের দ্বারা অর্থনৈতিক তেমন কোন সফলতা আসছিল না। কিছু কাজ ছিল বিবেকের তাড়নায় ও সৃজনশীলতার স্পৃহা হিসাবে।

এই কঠিন সময়ে আল্লাহ আমার অনলাইনের ঔষধ বিক্রিতে ব্যাপক বরকত দান করেন কুদরতিভাবেই। কারন আল্লাহ সবোর্ত্তম রিজিকদাতা। তিনিই এককভাবে বান্দার রিজিকের ফায়সালা করেন। আল্লাহর মেহেরবানীতে আমার তৈরী “মাজুনে মুমসিক” ঔষধটি কেবল তখন থেকে আজ পর্যন্ত সমানভাবে বাজারে চলতে থাকে। ঔষধ কম্পানীকে সর্বশেষে ব্যাবসা হিসাবে একটি মানে উন্নতির চেষ্টা করেছি। এর ভিতর দিয়ে শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতা ও আমার ব্যাবসা থেকে আব্বার উন্নত চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সর্বাত্ত্বক চেষ্টা চালিয়ে যাই। কেবল বড়দাগে আমি ৩২লক্ষ টাকা গত চার বছরে ব্যায় করি আব্বার চিকিৎসার পেছনে। এর বাহিরে ছোটখাটো চিকিৎসা খরচ, নিয়মিত ঔষধপত্র তো আছেই।

সাথে বাবার স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর ও রুচিসম্মত আলাদা খাবার, ঢাকা শহরে ব্যায়বহুল সংসার খরচ, বড় অংকের বাসা ভাড়া, বাচ্চাদের পড়ালেখার ব্যায়তো ছিলোই। সর্বশেষ আব্বার মৃত্যুর আগে প্রতিমাসে চিকিৎসা ব্যায় ছিল আমার লিমিটের অনেক বাহিরে। কেবল দৈনিক ৬০০ টাকার ঔষধ লাগতো প্রতিদিন। তবুও একদিনের জন্য চিকিৎসা বা ঔষধ বন্ধ হয়নি আল্লাহর মেহেরবানীতে। আব্বা যা খেতে পছন্দ করতেন তা সব সময় আনার ও খুশি রাখার সবোর্চ্চ চেষ্টা করেছি এবং আল্লাহ তাওফিক দান করেছেন। এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আব্বার খেদমত করা ও দুআ পাওয়া।

সর্বশেষে গত রমজানের আগের দিন আমার মাথার উপর থেকে ছায়াবৃক্ষটি সড়ে যায়। আব্বা তার মাহবুবে হাকীকীর ডাকে সাড়া দিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। আব্বার ইন্তেকালের কষ্টটি ভুলে থাকা ছিল আমার জন্য বড় কষ্টের৷ ও বেদনা বিধুর বিষয়। আব্বার জীবনের শেষ এই ৫বছর অসুস্থ অবস্থায়ও ব্রেইন ভালো ছিলো, স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিলো ও সকল কথাবার্তা স্পষ্ট ছিলো। বসে বসে তেলাওয়াত, জিকির, পড়াশোনা ও নামাজ আদায় করতে পারতেন। নানান পরামর্শ ও গাইডলাইন দিতেন। বড়দের কথা বলতেন, আকাবির আসলাফ ও পূর্ব পুরুষের ইতিহাস বলতেন।

এই সমটুকো আমি ছিলাম তার ছায়াসঙ্গি। বাবাকে গোসল করানো, খাইয়ে দেয়া, তেল মাখিয়ে দেয়া, নক চুল কেটে দেয়া, টয়লেট ও পশ্রাবের ক্যাটেথার ব্যাগ পরিস্কার করা, নয়মিত হাত পা, শরীর টিপে দেয়াসহ যাবতীয় কাজ আমি পরম যতনে নিজ হাতে আগ্রহ ও প্রেমময় ভালোবাসার সাথে করেছি আলহামদুলিল্লাহ।

আব্বার ইন্তেকালের ৩দিন পর থেকেই শুরু হয় আমার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান “জামিয়া কাশিফুল উলুম ঢাকা” এর পথ চলা। যে প্রতিষ্ঠান নিয়ে স্বপ্ন ও গবেষণা করে আসছি বিগত দুই যুগ ধরে।আব্বার সাথে এনিয়ে প্রচুর গল্প ও পরিকল্পনার কথা বলতাম। আব্বা পরামর্শ ও দুআ করতেন। করোনার আগ থেকেই মাদরাসার জন্য বাসা দেখছিলাম। করোনা ও আব্বার খেদমত এই দুই নিয়ে আর সামনে আগানো সম্ভব হয় নি। আব্বার ইন্তেকালের পর মনে হলো তার ইসালে সওয়াবের জন্য এর চেয়ে উত্তম কোন কাজই হতে পারে না। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে, বিগত ৫ বছরের সকল ট্যাজিডি ও হালাতের পরেও নিজের শেষ সহায় সম্ভল যা ছিল সব ব্যায় করে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

আলহামদুলিল্লাহ তালিম, তরিবয়ত ও পড়ালেখার মানের ক্ষেত্রে আমি এই প্রতিষ্ঠানকে একটি বিশেশায়িত প্রতিষ্ঠান ও আদর্শ মাদরাসা হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আলহামদুলিল্লাহ কিছু কিছু জায়াগায় আমাদের সফলতা সর্ব মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলছে। বিশেষ করে আরবী ভাষা সাহিত্যে নতুন উদ্ভাবনী সহজ পদ্ধতি। আমরা চেষ্টা করছি উম্মতের সামনে উন্নত সিলেবাস, কারিকুলাম ও স্ট্যান্ডার্ড একটি রূপরেখা এবং নতুন শিক্ষা বিপ্লবের সূচনা করতে।

প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের মুহতামিম হিসাবে শত প্রতিকুলতার ভিতর দিয়ে সময় কাটালেও অনেক সময় দ্বীনদার! অনেকের মুখ থেকেও এমন কথা শুনতে হয় যা আমার বিগত ৫ বছরের সকল দুঃখ কষ্টের চেয়ে বেশি পীড়া দায়ক। এখন পর্যন্ত কোন প্রকার চাঁদা কালেকশন ছাড়া আমি প্রতিষ্ঠানটিকে সামনে এগিয়ে নিতে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আল্লাহর উপর আস্থা রেখে চেষ্টা করে যাচ্ছি। সাথে আমার সম্মানিত আসাতিজায়ে কেরামের, আন্তরিকতা, কুরবানী, নিরলস পরিশ্রম ও খেদমত ঈর্ষনীয়। আল্লাহ সবাইকে এর উত্তম বদলা দান করুন।

এসব পরিস্থিতির কারণে আমার ধারবাহিক অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছে। ঔষধ কম্পানীটির অবস্থা গত চারমাসে মারাসার ফিকির করতে না পারায় অনেকটা নিম্নমূখি। যদিও চেষ্টা করছি হালাল জিবিকার জন্য মাদরাসার পাশাপাশি ব্যাবসাকে আবার নতুন করে এখন চাঙা করার। কিন্তু সব মিলিয়ে এই সময়টি অনেক কঠিন বাস্তবতা পার করতে হচ্ছে।

একজন মাদরাসা পরিচালকের ঈদের আগের বাস্তবতা কতো কঠিন তা আমি এবার অনুভব করেছি। একদিকে ব্যাবসার মান্দা। আর যা আয় তার সকল ইনভেস্ট মাদরাসায় ডুকানো। তবুও নিজের কোন চিন্তার পরোয়া না করে, সকল উস্তাদ স্টাফদের দেড় লক্ষাধিক টাকা বেতন -বোনাস ঈদের আগেই ছুটির সময় দিতে পারাটি ছিল একজন প্রতিষ্ঠান পরিচালক হিসাবে একটি চ্যালেঞ্জ। আলহামদুলিল্লাহ সফলতা ও মানসিক এক বড় প্রশান্তি ছিল ঈদের আগে এটি পুরা করতে পারা। মাদরাসা দেয়ার পর থেকে, ব্যাবসা বানিজ্য, চাকুরী করার পরেও এটি নিয়মিত আমল, যে নিজের ঘরে খাবার না থাকলে সমস্যা নেই, কিন্তু মাদরাসার বডিং এর ৩বেলা খাবার রুটিন অনুযায়ী রাখতেই হয়। আল্লাহ এখন পর্যন্ত তাও চালাচ্ছেন।

অনেকেই মনে করেন মুহতামিমগন মাদরাসা খুলে ব্যাবসা করছেন। হ্যা নিঃসন্দেহে লাখ লাখ টাকা খরচ করে এটি আল্লাহর সাথে ব্যাবাসা জান্নাতের বিনিময়! আমাদের আকাবির আসলাফের জীবন ও ব্যাবসা এমনিই ছিল।

একটি অভিজ্ঞতা যে, পকেটে যখন টাকা থাকবে না, তখন হাত পকেটে ডুকেনা, আসমানের দিকেই উঠে। আর এটিই আনন্দ যে, আমার জীবনের উপর দিয়ে বিগত কয়েকবছর টানা ঝড় তুফান আর স্লাইকোন বয়ে যাওয়ার পরেও, শত বিপর্যয়ে ভেঙে না পরে, কাজ করার মতো মানসিক শক্তি, হিম্মত এখনো বাকী আছে আলহামদুলিল্লাহ। সাথে সাথে আল্লাহর মেহেরবানীতে দ্বীনের জন্য একটু কষ্ট ও কুরবানী বরদাশত করতে পারা আল্লাহ পাকের খাস মেহেরবানী।

এই ত্যাগটুকো কবুল করো দয়াময়।

লেখক- মুহতাতিম, জামিআ কাশিফুল উলূম ঢাকা,লেখক গবেষক অনুবাদক ও বহুগ্রন্থপ্রণেতা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো সংবাদ