মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ০৩:১৩ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিনিধি, হবিগঞ্জঃ ৭১’ সালে হত্যা ,ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ সহ নানা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দুর্ধষ লিয়াকত বাহিনীর প্রধান রাজাকার কমান্ডার ও আওয়ামীলীগ নেতা লিয়াকত আলী সহ তার অপর এক সহযোগী আলবদর নেতা আমিনুল ইসলাম ওরফে রজব আলীকে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সর্বোচ্চ রায় মৃত্যুদন্ড প্রদান করায় হবিগঞ্জের উপজেলা লাখাইয়ের নির্ভৃত পল্লী কৃষ্ণপুর সহ গোটা জেলা জুড়ে বইছে আনন্দের বন্যা।
সোমবার দুপুরে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি শাহিনুল ইসলামের নের্তৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ ওই দুই কুখ্যাত রাজাকারকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে রায় প্রদানের পরপরই ৭১’সালে সংঘটিত গণহত্যার স্থল সংখ্যালঘু অধ্যুষিত পল্লী হবিগঞ্জের কৃষ্ণপুরের নারী-পুরুষ সহ নানা পেশার সাধারন মানুষ আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে।
বিশেষ করে লিয়াকত ও রজব বাহিনীর হাতে নিহত মুক্তিযোদ্ধা সহ অসংখ্য নারী-পুরুষের স্বজ্বনরা বুকভরা আনন্দের মাঝেও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
এসময় শুধু মিষ্টি বিতরন করেই ওই রায়কে সকলে স্বাগত জানাননি বরং সংশ্লিস্ট গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় মিছিল- এক আনন্দ-সমাবেশ।
এতে মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ওসি অমলেন্দু বাবু ও নৃপেন দাশ সহ অনেকেই ওই রায়কে স্বাগত জানিয়ে রাজাকার কমান্ডার লিয়াকত ও রজব আলীর ফাঁসি দ্রুত কার্যকরের দাবী জানান এবং ৭১’সালে ওই দুই রাজাকার কর্তৃক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও নারীদের সম্ভ্রম লুটের মতো নানা অপরাধের তথ্য সংগ্রহ করে হবিগঞ্জের সাহসী ও সৎ হিসেবে পরিচিত কলম সৈনিক সাংবাদিক রফিকুল হাসান চৌধুরী তুহিন দৈনিক জনকন্ঠে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তুলে ধরায় তুহিন ও জনকন্ঠ সম্পাদক আতিকুল্লাহ খানের ভ’য়শী প্রশংসার পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা জানান তারা।
শুধু তাই নয়, ওই দুই রাজাকারের বিচার যথাযথ হওয়ায় এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ তার সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করেন। এদিকে উক্ত দুই রাজাকারের ফাসির আদেশ হয়েছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে একই সময় রাজাকার লিয়াকতের গ্রামের বাড়ী জেলার লাখাইয়ের মুড়াকড়ি গ্রামেও সাধারন মানুষ সড়ক সহ নানা অলিগলিতে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেন এবং কেজির পর কেজি মিষ্টি বিতরন করেন।
তবে এই রায় শুনে রাজাকার লিয়াকত পরিবারের সদস্যরা যেমন নিশ্চুপ ছিলেন, তেমনি তাদের মাধ্যমে যেন কোন অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি না হয় সেদিকেও হবিগঞ্জের এসপি মোহাম্মদ উল্ল্যার নির্দেশে সংশ্লিস্ট থানা পুলিশ ছিল ব্যাপক তৎপর ও সংশ্লিস্ট মামলার বাদী-স্বাক্ষীদের নিরাপত্তায়ও তাদের নজরদারী ছিল দেখার মতো।
এছাড়া এই রায়ের পরপরই জনকন্ঠের হবিগঞ্জ প্রতিনিধি ও আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থা কর্তৃক গঠিত জেলা স্বাক্ষী ও ভিকটিম সুরক্ষা কমিটির মেম্বার এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল হবিগঞ্জ জেলা শাখার আহবায়ক রফিকুল হাসান চৌধুরী তুহিনকে সংশ্লিস্ট ট্রাইব্যুনালের প্রধান সমন্বয়ক আইজিপি আব্দুল হান্নান খান পিপিএম, তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি নূর হোসেন, কৃষ্ণপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ওসি অমলেন্দু বাবু সহ তৎসংশ্লিস্ট গ্রাম এবং জেলার নানা পেশার সাধারন মানুষ ফোনে এবং ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে ওই দুই রাজাকারের বিরুদ্ধে সাহসী লেখনীর জন্য এমন রায়ের ফসল স্বজনরা পেয়েছে বলে উল্লেখ করে সাধুবাদ জানানোর পাশাাপাশি মিষ্টি মুখ করিয়ে এক উৎসবে মেতে উঠে।
৭১’সালে বি-বাড়িয়া কলেজের ছাত্র লিয়াকত আলী পাকিবাহিনীর পক্ষ নিয়ে তার নামে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলেন। অপরদিকে একই সালে যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে অস্ত্র চালোনার প্রশিক্ষিত হয়ে কিশোরগঞ্জের অস্টগ্রাম থানার আলীনগর গ্রামের রজব আলী ও ভৈরব হাসমত আলী কলেজে একাদশ শেনীতে পড়ুয়া এই ছাত্র এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের কলেজ শাখার এই সভাপতি এলাকায় আলবদর বাহিনী গড়ে তুলেন। দেশ স্বাধীনের পর লিয়াকত আওয়ামীলীগে যোগ দেন।
তার পর থেকেই তিনি একাধিকবার লাখাইয়ের মুড়াকড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং সেই সাথে সংশ্লিস্ট উপজেলা আওয়ামীলীগেরও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার সাথে আওয়ামীলীগ-বিএনপি অনেক নেতা ও জনপ্রতিনিধির ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ট সর্ম্পক। যা নিয়ে এখনও বহু ছবি কথা বলে।
এদিকে ১৯৭২ সালে রজব আলী সহ তার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে দালাল আইনে তিনটি মামলা হয় ও সে বিচারে তার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়। ১৯৮১ সালে রজব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ‘আমি আলবদর বলছি’ নামে একটি বই প্রকাশ করে।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলাকালে লিয়াকত আলী এবং রজব বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা একই সালের ১৮ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের উপজেলা লাখাইয়ের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত পল্লী কৃষ্ণপুর এবং বি-বাড়িয়া জেলার ফান্ডাউক ও অস্টগ্রামের মিঠামইন সহ আশপাশ এলাকায় ব্যাপক নারকীয় তান্ডব শুরু করে।
এসময় পাকিবাহিনীর সহায়তায় লিয়াকত ও আমিনুল ইসলাম ওরফে রজব আলী সহ তার সশস্ত্র সদস্যরা কৃষ্ণপুর গ্রামের নৃপেন রায়ের বাড়ীতে হানা দিয়ে রাধিকা মোহন রায় ও সুনীল শর্মা সহ ১৫ জন জ্ঞাত এবং ২৮ জন অজ্ঞাত সংখ্যালঘু হিন্দুকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া একই এলাকার চন্দিপুর ও গদাইনগর গণহত্যা ও লুটপাট চালায় এই রাজাকাররা। এসময় ১২৭জনকে হত্যা করা হয়। তাতেও ক্ষান্ত না হয়ে পাশ্ববর্তী অস্টগ্রাম থানার সদানগর গ্রামের শশ্মানঘাটে হত্যার মহোৎসবে মেতে উঠে ওরা।
সাবিয়ানগর গ্রামের চৌধুরী বাড়ী ও খাবারবাড়িতে হত্যাকান্ড সংঘটিত করারও অভিযোগ আনা হয়েছে লিয়াকত বাহিনীর বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, বি-বাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার ফান্ডাউক গ্রামের বাচ্চু মিয়া ও রঙ্গু মিয়াকে অপহরন ও নির্মমভাবে হত্যা করে ওরা।
এক পর্যায়ে ৭১’সালে লিয়াকত ও রজব বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত এমন জঘন্য অপকর্মের ঘটনা সাংবাদিক রফিকুল হাসান চৌধুরী তুহিন ধারাবাহিকভাবে দৈনিক জনকন্ঠে তার লেখনীতে তুলে ধরলে তা লাখাইয়ের কৃষ্ণপুর সহ গোটা হবিগঞ্জ ও পাশ্ববর্তী জেলা গুলোর মানুষের মাঝে ব্যাপক তুলপাড় সৃষ্টি করে। এসময় জনকন্ঠের সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ ও সংশ্লিস্ট রিপোর্টাও তুহিনের ভূয়শী প্রশংসা হয়। স্ব স্ব এলাকায় গড়ে উঠে এই বাহিনীর হোতা লিয়াকত ও রজবের ফাসির দাবীতে আন্দোলন।
সর্বশেষ আওয়ামীলীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে ৭১’সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে যুক্ত থাকার দায়ে রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের বিচারের লক্ষ্যে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর অভিযোগ প্রাপ্ত হয়ে লিয়াকত ও রজব বাহিনীর অপকের্মর তদন্ত শুরু করে সংশ্লিস্ট ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ সহ ৭টি অভিযোগ এনে তদন্ত কর্মকর্তা নুর হোসেন অভিযোগ পত্র দাখিল করলে বিগত ২০১৫ সালের ১৮ মে লিয়াকত ও রজবের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করেন বিজ্ঞ সংশ্লিস্ট ট্রাইব্যুনাল।
চলতি বছরের গেল ১৬ আগষ্ট শুনানী শেষে এই মামলার রায় ঘোষনার জন্য অপেক্ষামান (সিএডি) রেখেছিলেন সংশ্লিস্ট ট্রাইব্যুনাল। গতকাল রবিবার ৪ নবেম্বর বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নের্তৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ আজ এই মামলার রায়ের দিন ধার্য্য করেছিলেন।