বুধবার, ২৯ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫৩ পূর্বাহ্ন
করাঙ্গীনিউজ: জোট বেঁধে আন্দোলনের জন্য নিজেদের অভিন্ন দাবি ও লক্ষ্য চূড়ান্ত করেছে বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। শুক্রবার আ স ম আবদুর রবের উত্তরার বাসায় তিন পক্ষের নেতারা বসে এটি চূড়ান্ত করেন।
অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং ড. কামাল হোসেনের উপস্থিতিতে শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের পর রূপরেখা, দাবি, লক্ষ্য ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আজ বিকাল ৫টায় ড. কামাল হোসেনের বেইলী রোডের বাসায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
শুক্রবার প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার এ বৈঠকে বৃহত্তর জোট গঠন, ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন, নির্বাচন, আসন ভাগাভাগি ও নির্বাচনে জয়ী হয়ে একসঙ্গে দেশ পরিচালনার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক চলার সময় একটি মিছিল আ স ম আবদুর রবের বাসার সামনের সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিল থেকে নানা ধরনের স্লোগান দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বৈঠকে আন্দোলনের রূপরেখা, অভিন্ন দাবি ও লক্ষ্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। শীর্ষ নেতাদের নিয়ে আরও একদফা বৈঠকের পর এটি ঘোষণা করা হবে। শনিবার (আজ) এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে।’
সূত্র জানায়, বৈঠকে যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার পাঁচ দফা দাবি ও নয় দফা লক্ষ্য এবং বিএনপির সাত দফা দাবি এবং ১১ দফা লক্ষ্য সমন্বয় করে তিন পক্ষের অভিন্ন ৭ দফা দাবি এবং ১১টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এর আলোকে আগামী দিনের কর্মসূচি ও ঐক্যের রূপরেখা ঠিক করা হয়।
এ ছাড়াও বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া মিলে নতুন জোটের নাম ঠিক করা নিয়েও আলোচনা হয়। প্রাথমিকভাবে এই নয়া জোটের নাম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’। বিকল্প হিসেবে ‘জাতীয় যুক্তফ্রন্ট’ও হতে পারে। তবে সবকিছুই চূড়ান্ত হবে অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং ড. কামাল হোসেনের উপস্থিতিতে শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে।
যুক্তফ্রন্টের নেতা জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন শুক্রবার বলেন, ‘দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর আমরা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সম্মত হয়েছি। ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ভোটের অধিকার রক্ষায় একসঙ্গে আমরা আন্দোলন করব। এজন্য অভিন্ন দাবিদাওয়া, লক্ষ্য ও রূপরেখার খসড়া চূড়ান্ত করেছি। দুই-একদিনের মধ্যে আরও একদফা বৈঠকের পর এটি ঘোষণা করা হবে।’
বিএনপির পক্ষে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার পক্ষে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মেদ, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, দলটির কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদুল্লাহ কায়সার, ডা. জাহিদুর রহমান, জেএসডির সহসভাপতি তানিয়া রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী, দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ওমর ফারুক প্রমুখ এ বৈঠকে অংশ নেন।
বৈঠক শেষে নেতারা একসঙ্গে বারিধারায় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসভবন মায়াবীতে যান। সেখানে তারা বি. চৌধুরীর ৮৮তম জন্মদিন উপলক্ষে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। একসঙ্গে কেক কাটেন।
ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে ৭ ও ৮ অক্টোবর তিন পক্ষের নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের গুলশানের বাসায় এবং পরদিন জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের উত্তরার বাসায় পরপর দুটি বৈঠক করেন।
এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় ড. কামাল হোসেনের বেইলী রোডের বাসায় শীর্ষ নেতারা বসবেন। তিনি অসুস্থ থাকায় ওইদিন রাত ৯টায় আ স ম আবদুর রবের বাসায় তা স্থানান্তর করা হয়। যদিও শেষ মুহূর্তে এসে এ বৈঠকও স্থগিত করা হয়। এ অবস্থায় শুক্রবার বেলা ৩টায় আ স ম আবদুর রবের বাসায় বৈঠকে বসেন তিন পক্ষের নেতারা। এ বৈঠকেই আন্দোলনের কর্মসূচি, দাবি ও লক্ষ্য চূড়ান্ত হয়।
প্রাথমিকভাবে যেসব দাবিকে সামনে রেখে খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার নিশ্চিত করতে হবে। যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা ও নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালো আইন বাতিল করতে হবে। ভোটের ১০ দিন আগে থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের ফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও নতুন কোনো ধরনের মামলা না দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
প্রাথমিকভাবে যেসব লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- সুশাসন, ন্যায়ভিত্তিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করা। সংসদে, সরকারে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনাসহ প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ ও ন্যায়পাল নিয়োগ করা। ৭০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধান সংশোধন করা। সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, সৎ-যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগদানের জন্য ‘সাংবিধানিক কমিশন’ গঠন করা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা ও স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করা। দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা। সব নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চয়তার বিধান করা। কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারি অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা। নারীর সমতা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি ও দলীয়করণের কালো থাবা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স্বচ্ছতা ও জাবাবদিহিতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও কাঠামোগত সংস্কার সাধন করা। রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, জনগণের আর্থিক স্বচ্ছতা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নিশ্চিত, জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। নিু আয়ের নাগরিকদের মানবিক জীবনমান নিশ্চিত করা এবং দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বেতন-মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল ও কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেয়া। ‘সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্র“তা নয়’- এই নীতির আলোকে জনস্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সমুন্নত রেখে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সৎ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও বিনিয়োগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। বিশ্বের সব নিপীড়িতদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফেরত ও পুনর্বাসনের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা। একই সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর আধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়া। প্রযুক্তি ও সমর-সম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা।