শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ০৩:০১ অপরাহ্ন
এডভোকেট শাহ ফখরুজ্জামান:
সংবাদিকতা এবং আইনজীবী। একটি নেশা এবং আরেকটি পেশা। নেশা আর পেশা মিলে প্রতিদিন সমাজের এমন কিছু চিত্র দেখতে হয় যা নিয়ে মাঝে মাঝে বিমর্ষ হয়ে পড়ি। এই বিমর্ষ হওয়ার মূল কারনটি হল সমাজ থেকে কেন যেন মানবিকতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দয়া, মমতা এসব শব্দে হারিয়ে যেতে বসেছে। এর পরিবর্তে আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে অনৈতিকতা,অমানবিকতা,নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, জিঘাংসা, হিংসা এবং বিদ্বেষে ভরপুর সমাজ। ১৯ নভেম্বর শনিবার হবিগঞ্জে তিনটি ঘটনার সংবাদ তৈরি করতে গিয়ে আমার এই উপলদ্ধি এনে দিয়েছে। ঘটনাগুলোর আলোকপাত করলে বুঝা যাবে আমাদের সমাজ এখন কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার পৌর শহরের চরগাঁও আবাসিক এলাকায় তহুরা বেগম (৫৫) নামের ২ সন্তানের জননী হত্যার ঘটনাকে যেভাবে নাটকীয়তায় রুপ দিয়েছেন তার স্বামী ঝাড়– মিয়া তা যেন সিনেমাকেও হার মানিয়েছে। দাম্পত্য কলহের জের ধরে এবং হত্যা মামলা দিয়ে দুই মামাকে ফাঁসাতে বৃহস্পতিবার দিবাগত গভীর রাতে ঝাড়– মিয়া তহুরা বেগমকে গলা কেটে হত্যা করে বিছানায় লাশ ফেলে রেখে চলে যান মসজিদে। উদ্দেশ্য ফজরের নামাজ পড়বেন। জামাতের সাথে ফজরের নামাজ পড়ে ঘরে প্রবেশ করে শুরু করেন কান্না-কাটি। প্রতিবেশীরা এসে দেখেন একজন মুসল্লি ফজরের নামাজ পড়ে নিজ ঘরে এসে দেখে তার স্ত্রীর গলাকাটা লাশ। অনেকেই দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করেন। একজন মুসল্লির এই অবস্থা দেখে সমবেদনা জানানোটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পুলিশ এসে পেশাদারী কাজের অংশ হিসাবে ঝাড়– মিয়াকে ঠিকই নিয়ে যান তাদের হেফাজতে। স্বাভাবিক টেকনিক প্রয়োগ করে পেয়ে যান ঘটনার রহস্য। ঝাড়– মিয়া নিজ হাতে স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করার পর মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে পাড়লেও পুলিশের কাছে ঠিকই সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হন। পরে বিবেকের তারনায় আদালতেও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে বিষয়টি নিয়ে সকল সন্দেহ দূর করে দেন। পুলিশের এই দক্ষতায় সত্য উদঘাটনের পাশাপাশি রক্ষা পায় নিরিহ দুই ব্যাক্তি।
নবীগঞ্জের ঘটনার ছেয়েও হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে বানিয়াচং উপজেলার মক্রমপুর গ্রামে। ওই গ্রামের হাফিজিয়া এতিমখানা মাদ্রাসার আকরাম খান নামে এক দরিদ্র শিশুকে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আরও তিন শিশু-কিশোর মিলে যেখাবে হত্যা করেছে তাও সিনেমার গল্পকে হার মানাবে। মক্রমপুর গ্রামের দরিদ্র কৃষক দৌলত খান মৃত্যুবরণ করলে তার দুই ছেলেকে লালন পালনের জন্য তাদেও মা ফুলতারা খাতুন চলে যান বিদেশে। আকরাম ও তার ভাইকে ভর্তি করেন মাদ্রাসায়। মাদ্রাসায় থাকা সকল শিশুর নিজস্ব ট্রাংক থাকে। যার মাঝে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। আকরাম খান এর নিকট ১টি চাবি থাকত। সেই চাবি দিয়ে এতিমখানার অনেক ছাত্রের ট্রাংক খোলা যেত। তাই মাদ্রাসার কারো কোন কিছু চুরি হইলেই সকলে আকরাম’কে সন্দেহ করত। বিষয়টি বানিয়াচং থানার ওসি অজয় চন্দ্র দেব আমলে নিয়ে এই তথ্যের ভিত্তিতে কাজ শুরু করেন। এই ক্ল্যু কে সামনে নিয়ে উক্ত মাদ্রাসার ছাত্রদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তালার চাবিই খুলে দেয় আকরাম খান হত্যার রহস্য। পরবর্তীতে পুলিশ আকরাম খান হত্যায় জড়িত মাদ্রাসার ছাত্র ফখরুল মিয়া , ফয়েজ উদ্দিন এবং জাহেদ মিয়াকে গ্রেফতার করেন।পুলিশ তিন ছাত্রকে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে উক্ত তারা স্বীকার করে আকরাম হত্যার সাথে জড়িত থাকার কথা। তারা পুলিশকে জানায় কিছুদিন পূর্বে ফখরুল মিয়ার মাদ্রাসার বোর্ডিংয়ের ট্র্যাংক থেকে প্রথমে ৬০টাকা ও পরে ৫০ টাকা চুরি হয়। এই টাকা খোঁজাখুজি করে না পেয়ে ফখরুল মিয়া, জাহেদ মিয়া ও ফয়েজ উদ্দিন জানতে পারে আকরাম খানের নিকট একটি তালা খোলার চাবি আছে, যা দিয়ে অধিকাংশ ছাত্রের ট্রাংকের তালা খোলা যায়। তাদের সন্দেহ হয় আকরাম খান এই চাবি দিয়ে তার টাকা চুরি করিয়াছে। এ বিষয় নিয়ে ফখরুল মিয়া, জাহেদ মিয়া ও ফয়েজ উদ্দীনদের মনে আকরাম খানের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং আকরাম খানকে সুযোগ মত পেলে শিক্ষা দিবে বলিয়া পরিকল্পনা করে। ১৬ নভেম্বর প্রতিদিনের ন্যায় আকরাম খান(৯) সহ অন্যান্য শিশুরা ফজরের আজানের আগে ঘুম থেকে উঠে কোরআন পাঠ করিয়া পড়াশুনা শেষে সকালের নাস্তা খেয়ে সকাল ৯টার সময় এতিমখানার বোর্ডিংয়ে তাদের নিজ নিজ বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে। ফখরুল মিয়া,মোঃ ফয়েজ উদ্দিন, মোঃ জাহেদ মিয়া প্রতিদিন ভোর বেলা ফজরের নামাজের আগে বাড়ী থেকে মাদ্রাসায় চলে আসে এবং রাতে এশার নামাজের পর নিজ নিজ বাড়ীতে চলিয়া যায়। মাদ্রাসার রুটিন অনুযায়ী ১৬ নভেম্বর সকাল ১০টায় মসজিদের ভিতর সকলে ঘুমিয়ে পড়লেও ওই তিনজন ঘুমানোর ভান করিয়া আকরাম খানকে শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ খোঁজতে থাকে। সকাল ১১টার সময় আকরাম খান ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যায়। তখন ওই তিন ছাত্র আকরাম খানের গতিবিধি লক্ষ্য রাখে। তারা সুযোগ বুঝে বাথরুম করার উছিলায় বাথরুমে যায়। সেখানে গিয়ে ফখরুল মিয়া ভিকটিম আকরাম খান এর সাথে কথা বলতে বলতে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যার উদ্দেশ্যে মাদ্রাসা সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ফিশারীর (জলাশয়) বাউন্ডারির নিকট লাউ গাছের নিচে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়া যাওয়ার সময় ফখরুল মিয়া মাঠে থাকা নাইলনের রশি হাতে করে নিয়া যায়। তার পিছন পিছন ফয়েজ উদ্দিন ও জাহেদ মিয়াও সেখানে যায়। লাউ গাছের নিচে যাওয়ার পর তারা আকরাম খানকে টাকা চুরির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। একপর্যায়ে ফখরুল মিয়া ভিকটিম আকরাম খান এর দুই হাত একসাথ করিয়া বাঁধতে চায়। তখন আকরাম খান চিৎকার করলে জাহেদ মিয়া দুই হাত দিয়া তাহার মুখ চেপে ধরে। তারপর ফখরুল মিয়া ও ফয়েজ উদ্দিন তাকে লাউ গাছের নিচে মাটিতে ফেলে দুই হাত একসাথে করিয়া এবং দুই পা একসাথে করিয়া নাইলনের রশি দিয়া আলাদা আলাদা বাঁধে। পরে ফখরুল মিয়া লাউ গাছের নিচে পড়ে থাকা ইট দিয়া আকরামকে হত্যার উদ্দেশ্যে স্ব-জোরে মাথার ডান পাশে এবং পেটের ডান পাশে আঘাত করিয়া মারাত্মক রক্তাক্ত জখম করে। এতেও আকরাম খান এর মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়ায় তারা মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তিনজন মিলে আকরাম খানকে ধরাধরি করে পার্শ্ববর্তী ফিশারীতে (জলাশয়) নামিয়া সেখানে থাকা একটি নৌকা সংলগ্ন পানিতে উপুড় করিয়া ফেলে দেয় এবং ফখরুল মিয়া ভিকটিমের মাথায় ধরিয়া চুবাইতে থাকে। একপর্যায়ে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা ভিকটিমকে নৌকা সংলগ্ন পানিতে ফেলিয়া লাশ গোপন করে চুপিসারে মসজিদের ভিতর আসিয়া পূণরায় ঘুমানোর ভান করিয়া শুইয়া থাকে। পরবর্তীতে আকরাম খানকে খুজে পাওয়া না গেলে এই তিনজন ভিকটিমকে খোঁজে বের করার অজুহাতে নৌকা সেচ করার জন্য ঘটনাস্থলে যায় এবং ভিকটিমের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় লাশ তারা তিনজন মিলেই উদ্ধার করে। এই কিশোর বয়সে জলজ্যন্তভাবে একটি শিশুকে হত্যার পর কিভাবে তারা স্বাভাবিক থেকেছে তা কিন্তু চিন্তার বিষয়। শনিবার পুলিশ সেই রহস্য উদঘাটন করায় সেখানে স্বস্থি ফিরে আসলেও সমাজের এই অবস্থা নিয়ে ভাবার কি সময় আসেনি আমাদের?
চুনারুঘাট উপজেলার পাঁচগাতিয়া গ্রামের আলোচিত শামীম মিয়া হত্যা কান্ডের মূল রহস্য উদঘাটননের বিষয়টিও আমাদের কাছে আসে সেই শনিবার। ক্লু লেস এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত দুই আসামীকে গ্রেফতার করার পর দুইজনই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানন্দি প্রদান করে ঘটনার দায় স্বীকার করার পর যে তথ্য পাওয়া যায় সেটি হল শামিমের সৎ মা মালেকা খাতুনের পরামর্শে শামিমকে হত্যা করে লাশ গুম করে। পরে গোয়েন্দা পুলিশ তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে চুনারুঘাট উপজেলার বাড়ইউড়া গ্রামের মৃত আব্দুল জব্বারের ছেলে আব্দুর রহমান আদই (৪৮) ও পাঁচগাতিয়া গ্রামের আব্দুর রহমান এর ছেলে সোহেল মিয়া(৪০)কে গ্রেফতার করে। তারা শুক্রবার ও শনিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। গত ৩ মে রাত সাড়ে ১০টায় পাঁচগাতিয়া গ্রামের আব্দুল হক এর ছেলে ভিকটিম শামীম মিয়া (২১) মিরাশি বাজারে থাকা ওয়ার্কসপের বাতি বন্ধ করার কথা বলে বাড়ি হতে বাহির হয়। পরে রাতে বাড়িতে না ফেরায় শামীম মিয়ার পিতা আব্দুল হক সহ আত্মীয় স্বজনরা খোঁজাখুজি করতে থাকে। পরদিন ৪ মে সকাল ১০টার সময় পাঁচগাতিয়া গ্রামের জনৈক আছকির মিয়ার চারা বাগানে গুরুতর জখম অবস্থায় ভিকটিম শামীম মিয়ার মৃতদেহ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে আঃ হক বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তভার জেলা গোয়েন্দা শাখা হবিগঞ্জে ন্যস্থ করা হয়। জেলা গোয়েন্দা শাখার সদস্যদের সমন্বয়ে ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আসামী মোঃ আঃ রহমান আদই(৪৮)কে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর গ্রাম থেকে এবং শুক্রবার রাতে সোহেল মিয়াকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দুর্বার মোড় থেকে গ্রেফতার করা হয়।
তিনটি ঘটনায় পুলিশ ধন্যবাদ পাওয়ার মত কাজ করেছে। কিন্তু সমাজে যে বড় ক্ষত উন্মোচন হল তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।রবিবার রাতে যখন এই তিনটি বিষয় নিয়ে লেখাটি তৈরি করছি তখন আমার সাথে দেখা করেন সাবেক কমিশনার আব্দুল মোতালিব মমরাজ ভাই। তিনি আমাকে জানান আধুনিক স্টেডিয়ামের পাশে ময়লার স্তুপে এক নবজাতক ছেলের লাশ পেয়ে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে রাজনগর কবরস্থানে দাফন করেছেন। এই তথ্যটিও আমার সমাজের বর্তমান অবস্থার চিত্র তুলে ধরার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয়েছে।
আমাদের সমাজে যেভাবে অর্থনৈতিক অগ্রসর হচ্ছে সেভাবে শিক্ষা, নৈতিকতা,মূল্যবোধের বিকাশ হচ্ছে না সেটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই ঘটনাগুলো। ডিস আর ইন্টারনেটের আসক্তি এবং মাদকের প্রভাবের পাশাপাশি যথাযথ তদারকির অভাবে আমাদের গন্তব্য এখন এক অনিশ্চিত যাত্রাপথে রয়েছে। এই যাত্রাপথে জীবনের মূল্য কতটা তুচ্ছ তার প্রমাণ সমসাময়িক এই ঘটনাগুলো। এই অবস্থার পরিবর্তনের কাজটি শুরু করতে হবে পরিবার,সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে। আর না হলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি আমাদের জন্য কোন আর্শীবাদ না হয়ে অভিশাপ হয়েই আমাদেরকে পিছন যাত্রায় নিয়ে যাবে।
লেখক:
সাংবাদিক ও আইনজীবী
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব।