শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ০২:১৩ অপরাহ্ন
ফয়সল আহমদ রুহেল: এক সময় যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হয়ে শিক্ষকদের সহচার্যে পড়াশোনা করেছেন, সেই প্রতিষ্ঠানে আবার সহকারী শিক্ষক হয়ে ফিরে আসা। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক। অত:পর সেখান থেকে অবসর। যেখানে আরম্ভ সেখানেই শেষ। এর চেয়ে বড় পাওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে আর কী-ই-বা হতে পারে। নিজেদের কর্মগুণেই শ্রদ্ধাভরে তাঁরা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন। এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হলেন মো. নিজামুল ইসলাম। তিনি নবীগঞ্জ উপজেলার দীঘলবাক উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।
জন্ম : হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা তীরবর্তী ছায়াসুনিবিড় প্রত্যন্ত অঞ্চল ঐতিহ্যবাহী দীঘলবাক গ্রাম। সেই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কলমদর মিয়া ও সুন্দর বিবির কোল আলো করে ১৯৫৬ সালের ৩১ অক্টোবর আসেন মো. নিজামুল ইসলাম। পিতার পেশা ছিল কৃষি আর মা ছিলেন গৃহিনী। সাত ভাই আর চার বোনের মধ্যে নিজামুল ছিলেন নবম। পিতা-মাতা অনেক আগে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
শিক্ষাজীবন : তিনি ১৯৬৬ সালে দীঘলবাক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৭২ সালে শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী দীঘলবাক উচ্চ বিদ্যালয়ে হতে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর মৌলভীবাজার কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে বাণিজ্য বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। একই কলেজ থেকে ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে তৃতীয় বিভাগে বি.কম ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে উচ্চতর দ্বিতীয় শ্রেণীতে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেন।
শৈশব : পিতা-মাতা অতি আদরে নাম রাখেন নিজামুল ইসলাম। নিজাম অর্থ জ্ঞানে সাধক। মনে হয় এ থেকেই নামের উৎপত্তি। মা-বাবা শিক্ষার প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। এই শিক্ষকের যতদূর মনে পড়ে ছোটবেলায় বড় বোনের হাত ধরে গ্রামের একটি বালিকা বিদ্যালয়ে যেতেন। আর সেখান থেকেই শিক্ষা জীবনের সুত্রপাত ঘটে।
১৯৬২ সালে দীঘলবাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেঞ্চে বসে থাক্কা দিয়ে বেঞ্চ থেকে ফেলে দেওয়ার স্মৃতি আজও মনে পড়ে নিজামুলের। প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে ১৯৬৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯৬৭ সালে শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী দীঘলবাক উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। মা-বাবা, ভাই-বোনের সাথে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার তাগিদে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটাছুটির দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি তিনি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ঐ বৎসরই শেষের দিকে মৌলভীবাজার কলেজে বাণিজ্য বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হস। ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে মৌলভীবাজার কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে বি.কম ডিগ্রি অর্জন করেন। অবশেষে ১৯৮৭ সালে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে উচ্চতর দ্বিতীয় শ্রেণীতে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেন।
শিক্ষকতা জীবন : মো. নিজামুল ইসলাম বি.কম পাশ করে গ্রামে ফিরে ১৯৭৯-১৯৮০ ইং দুই বৎসর নিজ বিদ্যালয় দীঘলবাক উচ্চ বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে জীবনের প্রথম মানব সেবায় ব্রত হন ।পরবর্তীতে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান, বাচনভঙ্গি, নিরলস শ্রম দেখে মেনেজিং কমিটি ও সেই সময়ের প্রধান শিক্ষক জনাব সায়েস্তা মিয়া জায়গিরদার ( নিজ করুয়া , বলাগঞ্জ ) ১৯৮০ সালের ১ অক্টোবর সহকারী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দান করেন নিজামুল ইসলামকে। ১৯৮৪ সালে এমপিও ব্যবস্থা চালু হলে তিনি সহকারী শিক্ষক হিসাবে এমপিওভুক্ত হন। ২৯ বছর ১০ মাস সহকারী শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১০ সালের ১ আগষ্ট হতে প্রধান শিক্ষক হিসাবে বিধি মোতাবেক নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সর্বমোট ৩৬ বছর ১ মাস শিক্ষকতার পর দীঘলবাক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৬০ বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়ায় বিধি মোতাবেক অবসর গ্রহণ করেন।
পারিবারিক : মো. নিজামুল ইসলাম ১৯৮৫ সারে ৮ জানুয়ারি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলাধীন কামারগাঁও গ্রামের হাজী বাড়ি নামে খ্যাত সম্ভ্রান্ত পরিবারে বদরুন-নাহার বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। গুণী এই মানুষটি কর্মক্ষেত্রে তিনি যেমন সফল তেমনি পরিবার প্রধান হিসেবেও। এই শিক্ষকের ছেলে-মেয়ে ৫জন। বড় মেয়ে তাহমিনা বেগম ইংরেজীতে অনার্স, মাস্টার্স। বর্তমানে জুনিয়র অফিসার ইসলামী ব্যাংক, জিন্দাবাজার শাখা সিলেটে কর্মরত। একমাত্র ছেলে মায়দুল ইসলাম গণিত বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স। তিনি সোনালী ব্যাংক, সিলেটের কোর্ট বিল্ডিং শাখায় অফিসার পদে কর্মরত আছেন। দ্বিতীয় মেয়ে সুমনা বেগম রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স, মার্স্টাস। দীঘলবাক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। তৃতীয় মেয়ে রুমানা বেগম (প্রকৌশলী) ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড প্রোডাক্টশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) এ অনার্স, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়। বর্তমানে উচ্চ শিক্ষা লাভে পূর্ণ স্কলারশীপ নিয়ে আমেরিকার মন্টানা স্টেইট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়নরত। ৪র্থ মেয়ে ফাতেমা ইসলাম তানিয়া-চট্টগ্রাম প্রকৌশলী বিশ^বিদ্যালয় (চুয়েট)- এ ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার (ইইই) বিষয়ে ৪র্থ বর্ষে অধ্যায়নরত। ছেলে-মেয়ে সকলই পিতার সেই প্রিয় বিদ্যাপীঠ দীঘলবাক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেছেন। ছেলে-মেয়ে সবাই প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তিনি পিতা হিসেবে পরম করুনাময় আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন।
শৈশব থেকেই নিজামুল ইসলামের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ ছিল। রাত্রে পড়া, সকালে পড়া, বিকালে অংক কষা-এ যেন এক প্রাত্যহিক রুটিনে পরিণত ছিল। আজকাল সে ধরনের লেখাপড়া খুব কমই চোখে পড়ে। সেই সময়ে অর্ধেক মূল্যে পুরাতন বই ক্রয় করতেন। কিন্তু এখন জানুয়ারির প্রথম দিন সরকার বিনা মূল্যে বই ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দিচ্ছে, উপবৃত্তি প্রদান করছে।
তিনি শিক্ষকতা জীবনে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক দিকটি বিবেচনায় নিয়ে যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছেন। কর্মরত শিক্ষকগণ ছিলেন শিক্ষা পরিবারের সদস্য। শিক্ষকরা কষ্ট পাবে, এরকম কোন মনমানসিকতা নিজামুল ইসলামের ছিল না। শিক্ষকরা তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। আজও শিক্ষকরা নিজামুল ইসলামের সময়কে স্বর্ণযোগ বলে আখ্যাতি করেন। নিজামুল ইসলাম প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে তেরোজন শিক্ষকের নিয়োগ হয়েছে। তাঁর অবসরকালীন সময়ে কেউ এ কথা বলতে পারবে না যে, নিয়োগ বিনিময়ে এক কাপ চা পান করেছেন তিনি। এজন্য নবীগঞ্জ উপজেলার শিক্ষক সমাজে নিজামুল ইসলামের এ ধরনের ইতিহাস নেই। সবাই চিনে, জানে, শ্রদ্ধা করে। তিনি সংস্কৃতিমনা মানুষ ।স্কুলে প্রত্যাহিক সমাবেশে তিনি জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করে ছাত্র শিক্ষকের পরিচিতি লাভ করেছিলেন। স্কুল-কলেজের স্যারদের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি কম ছিল না। লেখাপড়ার জীবনে তিনি কখনও ভোগ বিলাসী ছিলেন না। পারিবারিক ব্যয় অন্যান্য ভাই-বোনদের লেখাপড়ার ব্যয় এবং তাঁর যাবতীয় ব্যয় সংকুলন করতে মা-বাবা যাতে কষ্ট না পান সেই দিকটা নিকট ছিল মুখ্য বিষয়। ছাত্রজীবনে তিনি কখনও প্রাইভেট পড়েননি। শিক্ষকতা জীবনে কাউকে প্রাইভেট পড়াননি। একটা আত্মবিশ্বাস ছিল, চেষ্টা করলে অসম্ভব সম্ভব হয়।
কৃতিত্ব : শিক্ষকতা একটা মহান পেশা। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের নিকট আমানত স্বরূপ। তিনি শিক্ষকতা জীবনে সে দায়িত্ব যথাযথ পালন করার চেষ্টা করেন। তিনি কর্ম জীবনে অনেক স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সংস্থা বিশেষ করে নবীগঞ্জ এডুকেশন ট্রাস্ট, বাদশা মিয়া এডুকেশন ট্রাস্ট, নবীগঞ্জ এডুকেশন ট্রাস্ট ইউকে, শেভরন বাংলাদেশ লি. থেকেও সম্মাননা ক্রেস্ট পেয়েছেন। তাঁর সময়ে বিদ্যালয়ে অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সমাজ কল্যাণমন্ত্রী, পানি সম্পদমন্ত্রীসহ অনেক গুণীজনের আগমণ ঘটেছিল।
স্মরণীয় ঘটনা : নিজামুল ইসলামের শিক্ষকতা জীবনের শেষ প্রান্তে স্কুলের সত্তর বছর পূর্তি অনুষ্ঠান ছিল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেবের আগমনে ছাত্র, প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, এমপি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং এলাকাবাসীর পদচারণায় স্কুল প্রাঙ্গনে যেন এক মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে এত বড় অনুষ্ঠান আমি আর কখনও দেখি নাই। শিক্ষামন্ত্রীর আগমনের সুবাদে আজ দীঘলবাক উচ্চ বিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজে রূপান্তর হয়েছে। নিজামুল ইসলামের অনেক ছাত্র দেশে বিদেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, ব্যাংকার, বিভিন্ন পেশায় সরকারী বেসরকারী ক্ষেত্রে কর্মরত আছেন। তিনি তাদের জন্য গর্ববোধ করেন। নিজামুল ইসলামের অনেক স্যার আজ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আজ অবসর সময়ে যখন নিরবে বসেন তখন স্যারদের জন্য মন নিরবে নিভৃত্তে কাঁদে। তিনি প্রয়াত স্যারদের আত্মার শান্তি কামনা করেন।
তিনি স্কুল কলেজে অধ্যায়নকালীন সময়ে শ্রদ্ধেয় স্যারগণের পাঠদান পদ্ধতি, বাচনভঙ্গি, নৈতিকতা অনুসরণ করেন। এ প্রসঙ্গে নিজামুল ইসলাম বলেন, আমি নবম শ্রেণীতে অধ্যায়নকালীন একটি স্মরণীয় ঘটনা আজও আমার মনে পরে। আমার বাংলার স্যার বিরেন্দ্র বিহারী ভৌমিক ছিলেন কলিকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধীন প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ। একদা জেলা শিক্ষা অফিসার স্যারের শিক্ষাগত যোগ্যতা শুনে তিরস্কার কলেছিলেন। পরবর্তীতে স্যারের বজ্রকণ্ঠে রাবনের বিলাপ কবিতার প্রথম চার লাইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুনে স্যারের মাথায় হাত রেখে জেলা শিক্ষা অফিসার বলেছিলেন, অসাধারণ, অসাধারণ প্রতিভা। দেশ ও জাতি আপনার মত প্রতিভাবান শিক্ষকদের প্রত্যাশা করে।
নিজামুল ইসলামও শ্রেণীকক্ষে সেই পাঠদান পদ্ধতি অনুকরণ করেছিলেন। তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত সততা, নিষ্টা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
এ সত্যটুকু নবীগঞ্জ উপজেলার সম্মানিত শিক্ষকগণের নিকট সমাদৃত। তাঁর-ই স্বীকৃতি স্বরূপ এই গুণী মানুষটি অবসরে যাওয়ার প্রাক্কালে ২০১৬ সালে নবীগঞ্জ উপজেলার সম্মানিত সকল শিক্ষকগণ সর্বসম্মতিক্রমে শিক্ষক কর্মচারী সমিতি নির্বাচনে তাঁকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করে। অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়ায় অভিষেক অনুষ্ঠানে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করেন।
মানুষ মরণশীল। এ সত্য অবধারিত। মা-বাবা এহকাল ছেড়ে পরকালে চলে গেছেন। আর কখনও ফিরে আসবেন। এটা নিয়মির অমোঘ বিধান। মাতা-পিতার দোয়া সন্তানের ভবিষ্যতের পথ ও পাথেয়।
মানুষের জীবনে অনেক ঘটনার স্মৃতি কালের আবর্তে বিস্মৃতিতে পরিণত হয় আবার অনেক স্মৃতি চির অম্লান থাকে। অবসর সময়ে যখন এই শিক্ষক নিরবে বসেন তখন অনেক স্মৃতি মনের মানসপটে ভেসে উঠে। নিজামুল ইসলাম স্যার যখন বি.কম পাশ করেন তখন পাশের হার ছিল মাত্র ১৯%। তিনি ফলাফল জানার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। মা বারবার ফলাফল জানার জন্য প্রশ্ন করেন। সপ্তাহ খানেক পরে তিনি যখন ভলিবল খেলায় মত্ত তখন লোক মাধ্যমে জানলেন তিনি কৃতকার্য করেছেন। মাকে বলার সাথে সাথে মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিজামুলকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এ যেন দুঃখের অতিসহ্যের মত সুখের অতিসহ্যেও মানুষের মৃত্যু ঘটায়। মাকে শুধু এ কথা-ই বলছিলেন, ‘মা আমার জন্য দোয়া কর’।
দর্শনীয় স্থান সফর : শিক্ষা জীবনে, শিক্ষকতা জীবনে ও বিএড প্রশিক্ষণকালীন সময়ে অনেক দর্শনীয় স্থান সফর করার সুযোগ হয়েছে। মাধবকু-, ময়মানমতি, শালবন বৌদ্ধবিহার, জাফলং, সাতছড়ি, লাউয়াছড়া, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, ফয়েজলেক কক্সবাজার, সেন্টমার্টিনসহ আর অনেক স্থানে শিক্ষা সফরে যান। দীর্ঘ ৩৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক ম্যানেজিং কমিটি তথা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আর্থিক ভ্রমন ফি বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিযোগ ছিল না।
বিগত ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর অবসর গ্রহণের পর নিজ বাড়ী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বনকাদিপুর আমজাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি ও প্রতিষ্ঠাতার বিশেষ অনুরোধে ২০১৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে অবধি প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্কুলের এমপিও ভূক্তির কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করায় স্কুলটি এখন এমপিওভূক্ত।
বেঁচে থাকাদের মধ্যে এখন অনেকেই জীবনের চরম সত্য বার্ধক্যে উপনীত। নিজামুল ইসলাম মনে করেন, জীবনে অনেক পেয়েছি কিন্তু কতটুকু দিতে পেরেছি তা একমাত্র আল্লাহ-ই ভাল জানেন। বার্ধক্যের কারনে হয়তো শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আর সময়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। জানি না কখন, কোথায়, কিভাবে জীবনের শেষ বিদায় ঘণ্টা বাজবে।
গুনী এই শিক্ষক ২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্টিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশনের জরিপে নবীগঞ্জ উপজেলার আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার পদকে ভুষিত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, ফাউন্ডেশন হবিগঞ্জ জেলার আট উপজেলার ১৬ জন আদর্শ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে পদক দেয়ার পাশাপাশি তাদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)। পদকপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জন শিক্ষককে আর্থিক সহযোগিতাও দেবে সংস্থাটি।
জীবনের প্রয়োজনে সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি মানুষকে জন্মের সময় নানা রূপ, মেধা আর গুণ দিয়ে সৃষ্টি করেন। প্রতিটি রূপ এবং গুণ একেকটি ক্ষমতা। নিজামুল ইসলাম কৃষকের পরিবার থেকে আজ এ পর্যন্ত এসেছেন। তিনি বাবা-মার অনুপ্রেরণা, সাহস তাঁকে পথচলতে সাহায্য করেছে। নিজামুল ইসলাম তাঁর মতো সন্তানদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। সেক্ষেত্রে তিনি সফল ও যোগ্য পিতা।
শিক্ষকতা জীবনে এ শিক্ষক তাঁর সীমিত আয় সত্ত্বেও গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। এ বিদ্যাপীঠে নিয়ম শৃঙ্খলার অনুসরণ ও আদর্শ জীবন প্রণালী গঠনে তাঁর জুড়ি নেই। অভিভাবকদের মধ্যেও তিনি সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব।
আমরা আশাবাদী মানুষ, বিশ্বাস করি স্যারের উত্তরসূরীদের হাত ধরে একদিন স্যারের দেখা সব স্বপ্নই বাস্তবায়ন হবে। এখন শুধু সকলের নিকট দোয়া কামনা তাঁকে আল্লাহ যেন অনাগত দিনগুলি সুখে ও পরকালে শান্তি দান করেন। আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি ।