শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ১২:১৯ পূর্বাহ্ন
এম এ মজিদ:
নদীতে এতো স্বচ্ছ গাড় নীল পানি আর দেখা হয়নি। অস্বাভাবিক সৌন্দর্য্যে মন উতলে যায়। যে কারো মন চাইবে নীল পানি একটু ছুয়ে দেখি, গা ভেজাই। এর চেয়েও বেশি আপনাকে উদ্বেলিত করবে শত কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও হাজার ফুট উচ্চতার সুবিশাল পাহাড়। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অপরুপ পাহাড়ি সৌন্দর্য্য আপনি উপভোগ করতে পারবেন বাংলাদেশ থেকেই। ৩৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ও ৫৭ মিটার প্রস্থের যাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ গাড় নীল পানি আপনাকে বারবার টেনে নিয়ে যাবে সেখানে। যাদুকাটা নদীকে বলা হয় বাংলাদেশের রুপের নদী। একই নদীতে বালি, পাথর, কয়লার অস্তিত্বও বিরল। বাংলাদেশের অন্যতম সৌন্দর্যমন্ডিত এ নদীর অবস্থান সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার লাউড়েরগড় এলাকায়।
৫ নভেম্বর ২০২১ সকাল ৭টার দিকে হবিগঞ্জ থেকে আমাদের ৫টি মোটর সাইকেলে ১০ আইনজীবীর যাত্রা শুরু প্রকৃতি দেখায়। আমরা জানতাম যাত্রাটি অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ এবং কষ্টসাধ্য। ৩৫ বছর থেকে ৬২ বছরের আইনজীবীদের এক সংমিশ্রন ছিল আমাদের মাঝে। যাত্রার শুরুতেই এডভোকেট হাবিবুর রহমান খান (৬২) জানালেন ৪৮ ঘন্টার যাত্রায় আমরা আমাদের বয়সের ব্যবধানটা ভুলে যাব। আমাদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি নিজেকে অনেক বয়স্ক হিসাবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন তিনি হলেন এডভোকেট কামরুল ইসলাম। পর্যটন স্পটের আদি অন্ত নখদর্পে থাকা এডভোকেট জসিম উদ্দিন তো ছিলেনই। সব পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে সিদ্ধহস্ত এডভোকেট দেওয়ান জাকির হোসেন জাকারিয়া ও এডভোকেট শিবলী খায়ের অতুলনীয় সফরসঙ্গী।
এডভোকেট সফিকুল ইসলাম ছিলেন আমাদের যোগ্য ব্যবস্থাপক ও যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহনের একচ্ছত্র অধিকারী। নিজেদের চেহারার গুনে ও আচরণে তরুন আইনজীবী এডভোকেট আঙ্গুর মিয়া ও এডভোকেট নিজাম উদ্দিন আমাদের সফরকে অনেকটা সুন্দর করে তুলেছে। এডভোকেট সেলিম এবং আমি, “যে যেদিকে টানে সেদিকেই যাই” অবস্থানে ছিলাম।
রাণীগঞ্জ ফেরিঘাট পেরিয়ে দরগা বাজারে হঠাৎ আমার চোখের সামনেই একটি দ্রুতগামী সিএনজি অটো রিক্সা মাঝ রাস্তায় উল্টে গেল। রাস্তায় ছিটকে পড়ল এক নারী, মোটর সাইকেল থামিয়ে আমি সিএনজির ভেতরে থাকা যাত্রীদের টেনে টেনে বের করতে লাগলাম। আমি নির্বাক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম এক দেড় বছরের খুবই সুন্দর এক ছেলে শিশু সিএনজির ভেতরে থেকে কান্না করছিল। আমি তাকে কুলে নিতে চাইলে আহত মা বাকরুদ্ধ হয়ে ছেলেটাকে আগলে ধরে রাখলেন। আমি তাদেরকে একটি দোকানের চেয়ারে নিয়ে বসালাম। মা বাবা আহত হলেও শিশুটি সামান্যও আঘাত পায়নি। ইতিমধ্যে পথচারী মহিলাটি হয়তো মারাই গেছেন। আবারও আমাদের যাত্রা শুরু।
সুনামগঞ্জ শহরে জুমার নামাজ পড়ে আমার দুপুরের খাবার খেলাম পারভেজ হোটেলে। পারভেজ হোটেলের কালা ভুনায় অতিরিক্ত ঝাল আমাদের দীর্ঘদিন স্মরণ থাকবে। খাবার খেয়েই আমরা চলে গেলাম হাসন রাজা মিউজিয়ামে। জীর্ণশীর্ণ মিউজিয়ামে দর্শক সংখ্যা খুব একটা বেশি না। এবার আমাদের গন্তব্য বিশম্ভপুরের হাওর বিলাশে। ১২৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশম্ভপুর উপজেলার প্রায় বেশির ভাগই হাওর। ১ লাখ ৬ হাজার জনসংখ্যার বেশির ভাগই আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল। বিশম্ভপুর থানার পুলিশ অফিসার নজরুল ইসলাম জানালেন- অত্যন্ত শান্তশিষ্ট উপজেলাবাসীর মধ্যে ফৌজদারী অপরাধের সংখ্যা খুবই কম। কোনো কোনো ইউনিয়নে মাসের পর মাস কোনো পুলিশই যাওয়া লাগে না। সীমান্তে কিছু মাদকের অপরাধ ছাড়া আসলে সেখানে তেমন কোনো অপরাধের ঘটনাই ঘটেনা। রাতে ফিরলাম আমরা সুনামগঞ্জ শহরে।
রিভার ভিউ দেখতে দেখতে আমাদের একজন ফোন করলেন সুনামগঞ্জ জেলার ডিবি পুলিশের ওসি ইকবাল বাহারকে। আমাদের সবার পরিচিত ইকবাল বাহার সাথে সাথে গাড়ি পাঠালেন আমাদেরকে তার অফিসে নিয়ে যাওয়ার জন্য। জম্পেস আড্ডার পর আমাদেরকে নিয়ে গেলেন এ্যামব্রসিয়া চাইনিজ রেস্টোরেন্টে। সাথে যোগ দিলেন আজমিরীগঞ্জের পাহাড়পুরের সন্তান সুনামগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) প্রদীপ ও সেখানকার পাথর ব্যবসায়ী সফিক। দীর্ঘদিন হবিগঞ্জে চাকুরী করা ইকবাল বাহারের আতিথিয়তায় ছিল মনের গভীর থেকে ভালবাসার বহিপ্রকাশ। রাত ১১টার দিকে আমরা হোটেলে ফিরলাম। বারবার ফোন করে দাওয়াত দেয়ার পরও সময় স্বল্পতার কারণে আমরা যেতে পারিনি হবিগঞ্জের পইল গ্রামের বাসিন্দা সুনামগঞ্জের সুপরিচিত ব্যক্তি অজিত দাসের বাসায়।
পরদিন সকাল ৭টায় আমাদের যাত্রা লাউড়ের গড়, যাদুকাটা নদী, বারিক টিলা, বড়ছড়া, ট্যাকেরঘাট, লাকমাছড়া, শিমুল বাগান। বালির উপর দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে আমরা চলে গেলাম যাদুকাটা নদীর ফেরিতে। ফেরি থেকে রক্তাক্ত এক কিশোরীকে নিয়ে নামলেন তার বাবা। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত কিশোরী ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে চলেছে। এই অবস্থায়ই তাকে মোটর সাইকেলে তুলা হল, সামনে চালক, মধ্যে কিশোরী, পিছনে বাবা, গন্তব্য হাসপাতাল, বার বার মনে হল, কিশোরী কি চিকিৎসা নিতে পেরেছে না কি দুর্গম পথেই তার জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। ফেরিতে বসে এনজিও কর্মী দিলিপ জানালেন শান্ত এ নদী অনেক সময় অশান্ত হয়ে উঠে। পাহাড়ী ঢলে ভারতের মেঘালয় থেকে বড় বড় গাছ এসে পড়ে নদীতে।
গত বছর একটি বড় গাছের ধাক্কায় ফেরি উল্টে যায়, মারা যায় ফেরির সারেং। বালু, পাথর, কয়লা তুলতে আসা শ্রমিকরাও এভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়। নদী পেরিয়েই বারিক টিলা। ১৫০ ফুট উচ্চতার টিলা থেকে ভারতের মেঘালয়ের বিশাল পাহাড়, যাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ গাড় নীল পানি, বিশাল বালুকারাশি আপনাকে মুগ্ধ করবে। আমরা সেখানে বিজিবিকে অনেকটা নি®কৃয় দেখলাম। ছোট ছোট শিশুরা বস্তায় করে গাজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য দৌড়ে দৌড়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে, অথচ আড্ডায়রত দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজিবি। ঠিক এই জায়গাতে কেন আপোষ করা হয় তা আমি আজও বুঝিনি। দেশে বিদেশে পরিচিত বারিক টিলার বারিক মিয়ার ছেলে জয়নাল মিয়া থাকেন এখন বস্তিতে। তার নিজের কোনো জমিও নেই। বিশম্ভপুর ও তাহিরপুর যাওয়ার পথে আমরা স্কুল কলেজের ক্লাশে ও কোচিং এ যাওয়া ছেলে মেয়েদের পায়ে চম্পল স্যান্ডেল পড়া ছাড়া কোনো দাবী জুতো পড়া অবস্থায় দেখিনি। এর অর্থ হল সেখানকার মানুষ এখনও স্বচ্ছল হতে পারেনি। শিক্ষার হার কোনো কোনো উপজেলায় ১৭ শতাংশ।
রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে বড় কোনো অবকাঠামোও গড়ে উঠেনি। বারিক টিলার একটি দোকানের মালিক হুসনা আক্তার জানালেন টিলাটি সরকার নিয়ে গেছে, বারিক মিয়ার সন্তানরা এখন বস্তির বাসিন্দা। ট্যাকেরঘাট লেকের পাশেই ভারত। সতর্কবার্তা দেয়া-আন্তর্জাতিক সীমান্ত ক্রস করা যাবে না। লাকমাছড়া থেকে মেঘকে খুব কাছ থেকে দেখা যায়। লাকমা ছড়ায় ভারত বাংলাদেশ মিশে একাকার হয়ে গেছে। একটি দেড় ফুট উচ্চতার সীমান্ত পিলার আর দুই দেশের বিশ্বাস ছাড়া সীমান্ত বলতে কোনো কিছুই নেই সেখানে। বালিতে দাড় করিয়ে রাখা এডভোকেট জাকারিয়া ভাইর মোটর সাইকেলটি পড়ে যেতে পারে শুধু এ জন্য ৮ বছরের আমির দ্রুত একটি পাথরের টুকরা নিয়ে আসল মোটর সাইকেলের স্ট্যান্ডের নিচে দেয়ার জন্য। অথচ তাকে কেউ বলেনি কিছু। এতোটুকু বাচ্চার এমন চিন্তা শক্তি দেখে আমি অবাক হলাম। আমিরের বাবা নেই, আমি তাকে কিছু টাকা উপহার দিলাম। পরের গন্তব্য শিমুল বাগান।
যদিও শিমুল ফুটেনি, তারপরও এক অপরুপ সৌন্দর্য্য শিমুল বাগানে। বাদাঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন শখের বসে মানিগাও গ্রামে ২০০২ সালে ২ হাজার ৪শতক জায়গা ভরাট করে সেখানে রুপন করেন শিমুল গাছ। এখন সেটি তাহিরপুরের অন্যতম পর্যটন স্পট। সেখানে প্রবেশ ফি ২০ টাকা। আছে এক ডজনেরও বেশি ঘোড়া, ভাড়ায় ঘোড়া চড়া যায়। বিকাল ৪টার দিকে হবিগঞ্জ যাত্রা। রাত ৮টার দিকে আমাদের নিজ নিজ গন্তব্যে পৌছা। দুই দিনে প্রায় সাড়ে ৩শ কিলোমিটার মোটর সাইকেল চালানোর ক্লান্তি আমাদেরকে কাবু করতে পারেনি। ৩ হাজার ৬শ ৭০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুনামগঞ্জ জেলার গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্পটগুলোই হয়তো আমাদের দেখা হয়ে গেল। ভালো থাকুক বাংলাদেশ।
লেখক-
আইনজীবী ও সংবাদকর্মী