রবিবার, ১১ মে ২০২৫, ০৬:৫৮ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার : বাইক্কা বিলে ডিম দিয়েছে ‘বালিহাঁস’। নতুন অতিথির আগমনে মুখরিত বাইক্কা বিল। এখন কেবল ফুটার অপেক্ষায়। আর কিছুদিন পরেই ডিমগুলো থেকে ছানা ফুটে অনায়াসে নিজ থেকে নেমে যাবে বিলের পানিতে। তবে ইতোমধ্যে কয়েকটি বাক্সের ডিম ফুটে বালিহাঁসের ছানা বেড়িয়ে গেছে। এখন চলছে শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতি।
বিপন্ন প্রজাতির জলচর পাখি ‘ধলা-বালিহাঁস’। এর ইংরেজি নাম Cotton Pygmy-goose এবং বৈজ্ঞানিক নাম Nettapus coromandelianus। আকারে এরা ৩০-৩৭ সেন্টিমিটার অর্থাৎ আমাদের গৃহপালিত হাঁসের চেয়ে কিছুটা ছোট।
প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ার ফলে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল বালিহাঁসদের প্রজনন। তারা যেহেতু পুরাতন দীর্ঘদেহী গাছ বা পুরাতন ভগ্ন-অব্যবহৃত দালান কিংবা মঠ-মন্দিরের গর্তে বাসা তৈরি করে ছানা ফুটায়; তাই এগুলো না থাকার কারণে তাদের প্রজনন সংকট চরম আকার ধারণ করেছিল। বিষয়টি অনুধাবন করে তৎকালীন ‘মাচ্ প্রকল্প’ কৃত্রিম কাঠের বাক্সে বালিহাঁসের প্রজনন ব্যবস্থার সফল প্রয়োগ ঘটায়।
সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্ট্যাডিজের (সিএনআরএস) সাইড অফিসার মনিরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৭ সাল থেকে বাইক্কা বিলে আমাদের কৃত্রিম বাক্সের মাধ্যমে বালিহাঁসের সফল প্রজনন চলছে। প্রথম প্রথম কিন্তু তাতে বালিহাঁস ডিম দেয়নি। পরে তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ দেখে বাক্স ব্যবহার করতে শুরু করে।
তিনি বলেন, এখন প্রায় ৩০টি বাক্স থাকলেও প্রতি বছর ২০ থেকে ২০টি বাক্স তারা ডিম দেয়। এবার প্রায় ১৫টি বাক্সের মধ্যে বালিহাঁসের ডিম পাওয়া গেছে। একেকটি বাক্সে ছয় থেকে ১৬টি ডিম দিয়ে থাকে। ডিম থেকে ছানা ফুটতে প্রায় চার সপ্তাহ বা ২৭ থেকে ২৮ দিন সময় লাগে। প্রায় ২০০ বালিহাঁসের ছানা এবার বাইক্কা বিলের নতুন অতিথি হবে।
কৃত্রিম বাক্স এবং এর নিরাপত্তা সম্পর্কে মনিরুজ্জামান বলেন, আমরা সার্বক্ষণিক এগুলো নজরদারিতে রেখেছি। কেউ যেন বালিহাঁসদের বিরক্ত না করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাইক্কা বিল ভ্রমণে এসে অতি উৎসাহী কিছু লোক পাখির ছবি তোলার নামে তাদের প্রচণ্ড বিরক্ত করতে থাকেন। এটা কখনোই কাম্য নয়। এগুলো আমাদের নজরে এলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিই।
বাইক্কা বিলে বালিহাঁসের কৃত্রিম প্রজনন সম্পর্কে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি গবেষক ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, জেনে অত্যন্ত ভালো লাগছে, বাইক্কা বিলে বালিহাঁস ডিম দিয়েছে। আসলে প্রজনন সংকটের কারণে এক সময় আমাদের জলাভূমি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল এই প্রজাতিটি।
তিনি বলেন, বাইক্কা বিলে বালিহাঁসের কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে পাখি বিশেষজ্ঞ ড. পল থমসন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এই বাক্সটার মাপ কী হবে- এটা আমরা কিছুতেই নির্বাচন করতে পারছিলাম না। তখন পল থমসনের পরামর্শ ছিল, ‘আমেরিকান উড ডাক’-এর আকার যেহেতু আমাদের বালিহাঁসের মতো, তাই ওই হাঁসের মাপানুসারে আমেরিকাতে এই কাঠের বাক্স বানিয়ে পরীক্ষা করে দেখার পর সিদ্ধান্ত হয় এ মাপে হলেই হবে। এছাড়া বাইক্কা বিলে বালিহাঁসের এই সফল কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে মাজহারুল ইসলাম জাহাঙ্গীর বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।
বালিহাঁসের কৃত্রিম বাক্স তৈরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করে ইনাম আল হক বলেন, বাক্স ভুল মাপের হলে কিন্তু উল্টো ফল হবে। অর্থাৎ পাখির ছানাগুলো বাঁচবে না। আর বাক্স যদি বেশি গভীর হয় তাহলে বালিহাঁসের ছানা লাফ দিয়ে পানিতে পড়তে পারবে না। আবার অল্প গভীর হলে বাচ্চা পরিপূর্ণ হওয়ার আগেই পানিতে লাফিয়ে পড়বে কিংবা অন্য প্রাণীরা বাক্সের ভেতরে ঢুকে বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলবে। সেজন্য বাক্সের মাপ কিন্তু পুরোপুরি সঠিক হওয়া চাই।
তিনি এও বলেন, সবগুলো ডিম একত্রে ফুটলে মা বালিহাঁসটা পানি থেকে বাচ্চাদের উদ্দেশে ডাকতে থাকে। তখন বাচ্চাগুলো একে একে কৃত্রিম বাক্স থেকে লাফ দিয়ে দিয়ে পানিতে পড়ে যায়। তখন মা-বাবার পিছু পিছু ভেসে নিজ থেকে খাবার সংগ্রহ করে খেতে থাকে তারা।