শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ০৪:৩৮ অপরাহ্ন
সিদ্দিকুর রহমান মাসুম: হবিগঞ্জের বাহুবলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিট আলিফ সোবহান চৌধুরী সরকারি কলেজে সিনিয়রদের সঙ্গে জুনিয়র শিক্ষকদের নোংরামির কারণে শিক্ষার পরিবেশসহ পড়াশুনা ‘লাটে’ উঠছে। অনার্সের ২৫ জন শিক্ষকের ‘অসভ্যতার’ কারণে কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ সিনিয়র শিক্ষকরা রীতিমত দিশেহারা। গত ১৫দিন ধরে কলেজের পাঠদান কার্যক্রমই বন্ধ ছিল। আজ সোমবার থেকে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
জুনিয়র শিক্ষকদের করা অবৈধ একটি অভিযোগের ভিত্তিতে উপজেলা প্রশাসনের তদন্তের মুখে পড়েছেন কলেজটির ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান রতন দেব। ওই অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বিষয় না থাকলেও বাহুবল থানা পুলিশ দিয়ে কলেজ শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত করাচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী ছবি অধ্যক্ষের রুমে নেই অভিযোগ তুলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমানকে তার কক্ষে ৬ ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন ইংরেজি বিভাগের মাসুক মিয়ার নেতৃত্বে জুনিয়র (নন এমপিও ভূক্ত) শিক্ষকরা। এতে শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ। জোরেশোরে ছাত্র রাজনীতি না থাকলেও শিক্ষক রাজনীতির খপ্পড়ে পড়ে টালমাটাল হয়ে পড়েছে কলেজের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ।
এসব ঘটনায় ১২ জন জুনিয়র শিক্ষককে শোকজ করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। শোকজ পাওয়া শিক্ষকরা হলেন, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক প্রভাষ চন্দ্র পাল, মাসুক মিয়া, মুকিত মিয়া ও নাসরিন জাহান উর্মি, অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ ফরহাদুর রহমান, ফয়সল আহমেদ ও মিঠুন শর্ম্মা, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক আবুল খায়ের, তোফাজ্জ্বল হোসেন ও সোহেল মিয়া এবং বাংলা বিভাগের প্রভাষক জামাল উদ্দিন ও শামীম মিয়া।
ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মাসুক মিয়ার নেতৃত্বে ইংরেজি বিভাগের চারজন শিক্ষকসহ শোকজ পাওয়া ১২ জন শিক্ষক গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস বর্জন করে আসছেন। শোকজ প্রাপ্ত অন্যান্য শিক্ষক কলেজে অরাজকতা তৈরি করা ছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলমান ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় কক্ষ পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন না করে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। এমনকি গত ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার একটি অসত্য অভিযোগে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থী ও কলেজ ছাত্রলীগকে উসকে দিয়ে কলেজের পরিবেশকে অশান্ত করে তোলার পেছনেও শোকজপ্রাপ্ত দুই তিন জন শিক্ষক সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া শিক্ষকের স্ট্যাটাস থেকেও চাকুরিবিধি লঙ্গনের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কলেজটি সরকারি হওয়ার আগপর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন সাবেক সাংসদ আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী। ওই সময়ে কলেজে কিছু বিষয়ে অনার্স কোর্স খোলার জন্য খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্তরা ষ্ট্যাম্পের মধ্যে লিখিত দিয়ে বলেছিলেন, এই চাকরির জন্য তারা কোনোদিন এমপিওভুক্তির দাবি করতে পারবেন না। কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা মানতে হবে অনার্স শ্রেণিতে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের। কিন্তু এরইমধ্যে কলেজটি সরকারি হয়। সরকারি হওয়ার পর শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্মীকরণের কাজ শুরু হয়। আর এতেই কপাল খুলে যায় অনার্সে নিয়োগে পাওয়া খন্ডকালীন শিক্ষকদের। তারা এখন নানা অজুহাতে সিনিয়র শিক্ষকদের অপমান ও অপদস্থ করছে। আর সিনিয়র শিক্ষকদের অপমান করতে জুনিয়র শিক্ষকরা কোমলমতি শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগকে ব্যবহার করছে। এমনকী কেয়া চৌধুরীকেও শক্তি হিসেবে জুনিয়র শিক্ষকরা ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান এ প্রতিনিধিকে বলেন, নানা অন্যায় আবদারে রাজি না হওয়ায় জুনিয়র শিক্ষকদের কর্মকান্ডে কলেজটির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, জুনিয়রদের কথা না শুনলেই তারা যা খুশি করছে। তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান রতন দেবের বিরুদ্ধে একটি ভূয়া অভিযোগ দাখিল করেছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইউএনও উপজেলা মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার নেতৃত্বে তদন্ত কমিটিও গঠন করেছেন। এছাড়া গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে পাঠদান না করে কলেজের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগে ১২ জন শিক্ষককে শোকজ করা হয়েছে বলে তিনি জানান। জুনিয়র শিক্ষকদের পেছনে কারা ইন্ধন জোগাচ্ছে তাদের খূঁজে বের করার জন্য কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান অধ্যক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকদিন আগে বাহুবল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা হকের কাছে কলেজের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান রতন দেবের বিরুদ্ধে একই বিভাগে ষ্ট্যাম্পে সই দিয়ে নিয়োগ পাওয়া প্রভাষক মাসুক মিয়ার নেতৃত্বে চারজন শিক্ষক অনাস্থা জানিয়ে একটি অভিযোগ দেন। অভিযোগে বলা হয়, গত ২ বছর ধরে রতন দেব ‘ফ্রি-ষ্টাইলে’ ইংরেজি বিভাগ চালাচ্ছেন। যারা রতন দেবের কাছে প্রাইভেট পড়ে তারা ইনকোর্স পরীক্ষায় নম্বর বেশি পায়। কলেজের বেশিরভাগ ক্লাসই রতন দেব নিজে করান। বিভাগের অন্য শিক্ষকদেরকে ক্লাসে কম পাঠান। কোচিংক্লাসে বেশি শিক্ষার্থী পাওয়ার আশায় রতন দেব কলেজে বেশি ক্লাস নেন বলে অভিযোগে বলা হয়।
কলেজ থেকে এরকম অভিযোগ পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রথমে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমানকে বিষয়টি নিজেদের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু পরদিনই তিনি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে প্রধান করে রতন দেবের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির বাকী দুই সদস্য হলেন বাহুবল মডেল থানার ওসি (তদন্ত) এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে ইউএনও’র এমন আচরণে কলেজ কর্তৃপক্ষ হতভম্ব হয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের একজন শিক্ষক জানান, ওই তদন্ত কমিটিতে বাহুবল থানার ওসিকে (তদন্ত) রাখা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কলেজের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান রতন দেব কি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছেন, কোথাও কিছু চুরি করেছেন? এগুলো তিনি করেননি। তিনি কলেজ শিক্ষক। উত্থাপিত অভিযোগকে কেন্দ্র করে কলেজ শিক্ষকের বিরুদ্ধে থানা পুলিশ তদন্ত করবে কোন কারণে? ইউএনও’র তত্ত্বাবধানে এখন কলেজ পরিচালিত হয়। তারমানে এই নয়, তিনি অভিযোগ পাওয়া মাত্রই যাচাই-বাছাই না করেই তদন্ত কমিটি গঠন করে ফেলবেন?
অভিযুক্ত রতন দেব বলেন, বিভাগের জুনিয়র শিক্ষকদের নানা অন্যায় আবদার রাখতে না পারার কারণেই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে। বিভাগের সবার সঙ্গে আলোচনা করেই শিক্ষার্থীদের ইনকোর্স নাম্বার দেয়া হয়। প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ইংরেজি কঠিন বিষয় হওয়ায় বহু শিক্ষার্থী ও অভিভাবক আমার কাছে এসে প্রাইভেট পড়ানোর অনুরোধ করেন। এজন্যই প্রাইভেট পড়াই। সারাদেশেই ইংরেজি শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ান। এখানে আমার দোষ কোথায় বুঝতে পারছি না? সকলের পরামর্শে কলেজের ইংরেজি বিভাগ চালানো হয় বলে তিনি জানান। উপজেলার বড় একটি কলেজে একা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার উপায় নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কলেজের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যানকে নিয়ে যখন এই ‘নাটক’ চলছে তখনই ঢাকায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে পদসৃজনের সভার ডাক পড়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের। গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকাতে ওই সভায় যোগ দেয়ার জন্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্য থেকে চারজনের একটি কমিটি গঠন হয়। কিন্তু কমিটিতে খন্ডকালীন ও অনার্সকোর্সের জন্য নিয়োগ পাওয়া জুনিয়র শিক্ষকরা অধ্যক্ষের কাছে গিয়ে ‘আবদার’ করে বলেন, জুনিয়রদের নিয়ে পদসৃজনের সভায় যোগ দিতে হবে। কিন্তু অধ্যক্ষ এবং সিনিয়র শিক্ষকরা রাজি না হলে গত ১১ সেপ্টেম্বর রাতে জুনিয়র ও খন্ডকালীন শিক্ষকরা বাহুবল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করে বলেন, ‘আমরা নিন্মস্বাক্ষরকারী অনার্সের ৬টি বিভাগের শিক্ষকমন্ডলী। ইতোমধ্যে আমরা আমাদের মূল সনদপত্রাদি, মূল নিয়োগপত্র, মূল যোগদানপত্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্রাদি কলেজ অধ্যক্ষ মহোদয়ের নিকট জমা দিয়েছি। ১২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ভোর ৬টায় আলিফ সোবহান চৌধুরী সরকারি কলেজের চূড়ান্ত পর্যায়ের পদসৃজনের লক্ষ্যে অধ্যক্ষ মহোদয় উনার পছন্দের ৫ জন শিক্ষককে নিয়ে মাউশিতে যাচ্ছেন। আমরা ৬টি বিভাগের ২৫ জন শিক্ষক অধ্যক্ষ মহোদয়কে বারবার অনুরোধ করে বলি পদসৃজনের কাজে অনার্সের ৬ বিভাগের ৬ জন শিক্ষককে যেন সঙ্গে নিয়ে যান। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বর দিনের বেলা অধ্যক্ষ মহোদয় আমাদের জানান, পদসৃজনের কাজে অমাদের অনার্সের কোনো শিক্ষককে অধ্যক্ষ মহোদয় সঙ্গে নেবেন না। এমতাবস্থায় আমাদের অনার্সের ২৫ জন শিক্ষকের চূড়ান্ত পর্যায়ের পদসৃজন হবে কি না এবিষয়ে সন্দেহে আছি। পাশাপাশি আমাদের মূল কাগজপত্রাদির বিষয়েও সন্দেহে আছি। ইতোমধ্যেই আপনি কলেজের অনেক বিষয় জেনেছেন যেখানে সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে কলেজের অনার্সের ৬ বিভাগের ৬ জন শিক্ষককে সাথে নিয়ে পদসৃজনের কাজ শেষ করার জন্য আপনার সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পদসৃজনের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজে জুনিয়র ও খন্ডকালীন শিক্ষকদের নেয়ারই কোনো সুযোগ নেই। তবুও তারা যেতে চায়। কলেজের কোনো আদেশই তারা মানতে চায় না। এই শিক্ষকদের আবদার অধ্যক্ষ নাকচ করে দিলেও জুনিয়র শিক্ষকদের এরকম আবেদন পেয়েই ইউএনও আয়েশা হক তাদেরকে ‘প্রশ্রয়’ দেন। কলেজের অধ্যক্ষ কিংবা সিনিয়র কোনো শিক্ষকের সঙ্গে কথা না বলে ওই আবেদনের ওপরের অংশে অধ্যক্ষকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখে দেন,‘দেখলাম, জনাব মাসুক মিয়া, প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, পদসৃজনের কাজে প্রিন্সিপাল মহোদয়ের সঙ্গে ঢাকা যাবেন।’
ইউএনও আয়েশা হকের কাছ থেকে এই লেখা পেয়েই অনার্সের এই ২৫ জন শিক্ষক অধ্যক্ষসহ সিনিয়রদের কোনো পাত্তা দেয়নি। ১২ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা যথারীতি অধ্যক্ষের নেতৃত্বে সিনিয়র শিক্ষকরা মাইক্রোবাসযোগে ঢাকায় যাত্রা শুরু করেন। ইউএনও’র লেখার পরও তিনি জুনিয়র শিক্ষক মাসুককে সঙ্গে নেননি। মিরপুর থেকে অধ্যক্ষসহ সিনিয়র শিক্ষকরা ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রার পরই মাসুক মিয়ার নেতৃত্বে জুনিয়র শিক্ষকরা নিজেদের ভাড়াকরা মাইক্রোবাসে ঢাকায় রওয়ানা দেয়। মাউশিতে সভা শুরু হলে দেখা যায়, অধ্যক্ষ এবং সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে জুনিয়র শিক্ষক মাসুক মিয়া সভার ভেতরে চেয়ারে বসেন। তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, কলেজের চারজন শিক্ষক ছাড়া সবাইকে বাইরে যেতে হবে। কিন্তু জুনিয়র শিক্ষক মাসুক মিয়া না বেরোলে নিজের ইজ্জত রক্ষায় একপর্যায়ে অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমানই বাইরে চলে আসেন। ভেতরে থাকেন তিনজন সিনিয়র শিক্ষক এবং জুনিয়র মাসুক। অর্থাৎ মিরপুর আলিফ সোবহান চৌধুরী সরকারি কলেজের পদসৃজনের সভা হয়েছে অধ্যক্ষ ছাড়া। মূলত ওখান থেকেই অধ্যক্ষের ওপর ক্ষিপ্ত হন জুনিয়র শিক্ষকরা।
১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার কলেজ খোলার কয়েকঘন্টার মধ্যেই মাসুদুর রহমান মাসুক ফেসবুকে একটি ষ্ট্যাটাস দিয়ে বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা!!!!’। তিনি তাতে লিখেন, ‘আলিফ সোবহান চৌধুরী সরকারি কলেজে স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠন জামায়াতি অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মাহবুবুর রহমান বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি খুলে রেখে দিয়েছেন। আমরা বার বার বলার পর ও উনি জাতির জনকের ছবি টানাননি। এতবড় সাহস তিনি কোথায় পেলেন? স্বাধীনতা বিরোধি শক্তি কলেজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। আমরা সকল শিক্ষক এই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সহ অপসারণ চাই। অধ্যক্ষের অপসারণের জন্য ২৪ ঘন্টা সময়ও বেঁধে দেয়া হয়।’ এতে অনেকেই মন্তব্য করেন। কেউ কেউ অধ্যক্ষকে পিটিয়ে কলেজ থেকে বের করে দেয়ার কথাও বলেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, কলেজের অধ্যক্ষকে নিয়ে ফেসবুকে এরকম স্পর্শকাতর বিষয়ে ষ্ট্যাটাস দেয়ার পর চারদিকে আলোড়ন তুলে। হঠাৎ করে কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে কেন জাতির জনক এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি নেই-এর কারণ খূঁজতে গিয়ে জানা গেল, অধ্যক্ষের কক্ষে মেরামত কাজ হচ্ছে। একারণে ছুবি দুটি নামিয়ে রাখা হয়েছিল। কাজ চলার সময় অধ্যক্ষ আরেকটি কক্ষে বসে দাপ্তরিক কাজ সেরেছেন। যে কক্ষে দাপ্তরিক কাজ সেরেছেন সেখানেও অধ্যক্ষের মাথার ওপরে জাতির জনক এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি টানানো হয়েছিল বলে সিনিয়র শিক্ষকরা জানিয়েছেন।
একাধিক সিনিয়র শিক্ষক বলেছেন, ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পদসৃজনের সভায় মাসুকসহ অন্য জুনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে না যাওয়ার জোর করে মাসুক মিয়া সভায় উপস্থিত থাকলেও অধ্যক্ষসহ সিনিয়র শিক্ষকদের ওপর প্রচন্ড ক্ষ্যাপা ছিলেন। তাদের এই ক্ষ্যাপার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন ছবি নেই-অভিযোগ তুলে। কারণ কলেজের মেরামত কাজ শেষ হতে না হতেই অধ্যক্ষ ঢাকায় চলে গেছেন। ১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থাকায় অফিস বন্ধ ছিল। ১৪ সেপ্টেম্বর কলেজে এসে অধ্যক্ষের কক্ষে ছবিদুটো নেই অজুহাত দেখিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন মাসুক মিয়া। এই অভিযোগে মাসুক মিয়াসহ জুনিয়র শিক্ষকরা চেয়েছিলেন, অধ্যক্ষকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কারণে তা সম্ভব হয়নি। কারণ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। ফলে অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান বেঁচে যান।
কলেজের অনার্স কোর্স চালুর জন্য নিয়োগপাওয়া শিক্ষক মাসুকসহ ২৫ জন শিক্ষক হঠাৎ এত বেপোরোয়া হলেন কেন, কেন তারা অধ্যক্ষসহ সিনিয়র শিক্ষকদের মানছেন না? কলেজটি সরকারি না হলে যাদের চাকরিই ঝুলন্ত ছিল তাদের এই আচরণের কারণ খূঁজতে গিয়ে জানা গেছে, এই জুনিয়র শিক্ষকদের অধিকাংশই সাবেক সভাপতি আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত এবং এরা সকলেই নন-এমপিও শিক্ষক। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায় এম,পি কেয়া চৌধুরীর দ্বারা নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়ায় এই জুনিয়র শিক্ষকরা নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা আদায়ে বিভিন্ন সময় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে চাপ প্রয়োগ করে আসছেন। ক্ষেত্রবিশেষে তারা প্রকাশ্যে কেয়া চৌধুরীর লোক বলে প্রচারও করে। হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতাকেও তারা সুবিধামত ব্যবহার করে। আর এইভাবে তারা তাদের সুবিধা আদায় করে নেয়। আর তাদের চাপের কাছে নতি শিকার না করায় তারা গত কিছু দিন ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালিয়ে আসছেন।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর কলেজের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়। এরপর গত ১৫ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা হক কলেজে আসেন। এদিন তিনি সিনিয়র ও জুনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে কলেজে বৈঠকে বসেন। বৈঠকেই তিনি ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস এবং কলেজের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন। এমনকি ‘ফেসবুকে সরকারি ষ্ট্যাটাস বিধি’ও অনুসরণ করতে বলেন।
সর্বশেষ এরই জের ধরে আজ সোমবারও ছাত্রদের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ওই শোকজ পাওয়া শিক্ষকদেরই ইশারা ছিল ।
জানতে চাইলে কলেজের সভাপতি ও বাহুবল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা হক’কে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।