রবিবার, ১১ মে ২০২৫, ১২:৫৩ পূর্বাহ্ন
এম,এ আহমদ আজাদ,হাওরাঞ্চল প্রতিনিধি(বাংলাদেশ): সিলেটের হাওরাঞ্চলে বর্ষায় প্রধান বাহন নৌকা এখন বিলুপ্ত হওয়ার পথে। টাঙ্গুয়ার হাওরের কোল ঘেঁষে সবুজে ঘেরা ছোট গ্রাম তাহিরপুর । নদীর তীরে বসে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি নৌকা বানাচ্ছেন। নৌকাটি বানাতে তিনি বেশ ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছেন। সকাল গড়িয়ে সূর্য অস্তমিত প্রায়। কাজের তোড়ে তার সেদিকে কোনো নজরই নেই।
খলিলুর রহমান পেশায় একজন নৌকার কারিগর। তার বাড়ি দিরাই শাল্লা উপজেলার জটিরচর গ্রামে। তাহিরপুর গ্রামে তিনি এসেছেন জেলের নৌকা বানাতে। জেলেদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে সাত দিনের মধ্যে তিনি ২০ ফিটের একটি নৌকা তৈরি করে দেবেন। বিনিময়ে পাবেন ১৫ হাজার টাকা। হাওরের পানিতে এখন বড় বড় মাছ পাওয়া যায়। নৌকা তৈরি হয়ে গেলেই সেই নৌকা নিয়ে নামবেন হাওরের বুকে জাল ফেলতে।
নৌকার কারিগর খলিলুর রহমান জানান, মাত্র ১০/১২ বছর বয়সে শখের বসে নৌকা বানানো শুরু করেন। শুরুর সময়টাতে তার নৌকা বানানোর ওস্তাদ ছিলেন কদর আলি। কিশোর বয়সের সেই শখ এখন তার পেশায় পরিণত হয়েছে। তিনি এখন সবার কাছে নৌকার কারিগর হিসেবেই পরিচিত। খলিলুর রহমানের বয়স এখন ৬৫। তিনি প্রায় ৫০ বছর ধরে নৌকা বানিয়ে চলেছেন।
এখন বছরে ৪ থেকে ৫ মাস নৌকা বানান। এসময়ের মধ্যে তিনি চার থেকে পাঁচটি নতুন নৌকা বানানোর পাশাপাশি সংস্কারের কাজ করেন ১৫ থেকে ২০টির মতো। তবে একটা সময় তিনি একাই প্রতি বছর অন্তত ২০ থেকে ২৫টি নৌকা বানাতেন। কাজের চাপে কাউকে ফিরিয়েও দিতে হতো।
খলিলুর রহমানের দাবি, নৌকার কারিগরদের সেই দিন ফুরিয়েছে। তার গ্রামে এক সময় ৫০টির মতো নৌকার কারিগর ছিলেন। এখন কেউ মারা গেছেন, কেউ বা বৃদ্ধ হয়েছেন। নতুন করে এই পেশায় আর কেউ আসছে না। সেই সুযোগে লোহা বা টিনের তৈরি নৌকার চল ও চাহিদা বড়ছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে এখনও নৌকার কদর রয়েছে। এসব উপজেলার গ্রামের মানুষেরা অন্য কাজের চাইতে পদ্মা থেকে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। হাওর থেকে মাছ ধরে সেই হাওরের তীরেই সকালে বা বিকালে হাট বসিয়ে তা বিক্রি করেন ফড়িয়া বা আড়তদারদের কাছে। এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যেই সেই মাছ বিক্রি হয়ে যায়।
নৌকা কারিগর হবার কারণ হিসেবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘সে সময় বিশাল হাওর টাঙ্গুয়া। আপনারা হাওরের সেই রূপ দেখেন নাই। বর্ষা মৌসুমে ভরা টাঙ্গুয়া ডাকে রীতিমতো ভয় পেতো মানুষ। এই টাঙ্গুয়া তখন প্রচুর নৌকা চলতো। মাছ ধরা ও পণ্য আনা নেয়ার পাশাপাশি গ্রামে রাস্তা-ঘাট না থাকা বা দুরাবস্থার কারণে সেসময় মানুষ নৌকাতেই যাতায়াত করতো। আর তাই নৌকার কদরও ছিল বেশি। সেই চাহিদার কথা মাথায় নিয়েই এই নৌকা বানানো শেখা। আর এখন নৌকার কদর কমলেও অন্য কোন কাজ না জানায় তাকে এই কাজ ধরেই বসে থাকতে হয়েছে।’
নৌকা তৈরিতে ব্যয় বেড়েছে। ২০ থেকে ২৫ ফিট আয়তনের একটা নৌকা তৈরি করতে এখন খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা। আর ৫০ ফিটের একটা নৌকা তৈরি করতে খরচ হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। ৩০ ফিটের একটা নৌকা তৈরি করতে ১২ থেকে ২০ দিন সময় লাগে। একটি নৌকার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ সোল বা পানি বাতাস। এই অংশটি বানানোটাও বেশ কঠিন কাজ।
পাশেই টাঙ্গুয়ার তীরে একটি নৌকায় আলকাতরা লাগাচ্ছেন মধ্য বয়সী জামাল নামে এক ব্যক্তি। জামাল পেশায় জেলে। নৌকাটি তার নিজের। কারিগরের খচর বেশি হওয়ায় তিনি নিজেই নৌকার ছোটখাট কাজগুলো মেরামত করে থাকেন।
নৌকার গায়ে আলকাতরা লাগানোর এক ফাঁকে তিনি বলেন, ‘হাওরে সেভাবে আর মাছ নাই। বড় বড় শিকারিরা ফোল্ডিং চায়না জাল ফেলে ছোট বড় সব মাছ ধরে নিচ্ছে। ওদের কাছে আমাদের মতো জাল ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরা জেলেরা পাত্তা পাই না। এখন টাকা আছে যার টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ তার।