শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ১১:৫০ পূর্বাহ্ন
ফয়সল আহমদ রুহেল : লুঙ্গি-পাজামা পড়ে স্কুল জীবন কাটিয়েছেন। প্রতিদিন ৬/৭ কিলোমিটার রাস্তা খালি পায়ে হেঁটে স্কুলে আসা-যাওয়া করতেন। স্কুলে আসার সময় বাবা টিফিনের জন্য দিতেন না একটি পয়সাও। দুপুরে স্কুলে টিফিন ছিল সিঙ্গারা কিংবা খাজা। বড় ভাই আসান উল্ল্যাহর মত শিক্ষিত হয়ে একদিন আদর্শবান মানুষ হবেন এমনটা স্বপ্ন ছিলো। বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণে শিক্ষা জীবনের এক একটি ধাপ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এগিয়ে যান। একজন কৃষকের সন্তান হয়ে প্রথমে সহকারি শিক্ষক ও পবর্তীতে প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসর। হবিগঞ্জ শহরের জেকেএন্ড এইচকে উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহমান স্যার এর স্বপ্ন পূরণের কথা বলছি।
জন্ম: ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি গ্রামের মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন আব্দুর রহমান। তার বাবার মরহুম মফিজ উল্ল্যাহ ও মাতা তৈমুননেছা বেগম। ৪ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে তিনি ৩য়।
শিক্ষা জীবন : আদর্শবান শিক্ষক মো. আব্দুর রহমান ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি ৫ বছর বয়সে রিচি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে সফলতার সাথে ৫ম শ্রেণীতে উর্ত্তীণ হন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালের ১৯ জুলাই আবারও হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়েও ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। ওই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনস্থ এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি সরকারি বৃন্দাবন কলেজ হবিগঞ্জ এ ভর্তি হয়ে ১৯৭২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৬ সালে একই কলেজ থেকে তিনি সফলতার সাথে বিএসসি পাশ করেন। ১৯৮২-৮৩ সেশনে বি.এড ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি।
কর্মজীবন : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. আব্দুর রহমান স্যার শিক্ষা জীবন শেষ করে ১৯৭৭ সালে ১০ অক্টোবর লাখাই উপজেলার রাঢ়িশাল-করাব উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে শিক্ষকতার মত মহান পেশার সাথে যুক্ত হন। সেখানে ১৯ বছর সুনামের সাথে চাকুরী করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেকে এন্ড এইচকে উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। ওই স্কুলে ৭ বছর সফলতার সাথে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় ১৯৯৩ সালের ১ জুলাই তাকে সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোনতি দেওয়া হয়। পরে একই বছরের ২৩ আগস্ট ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। প্রায় ১৯ বছর প্রধান শিক্ষক পদে সত্যতা ও নিষ্টার সাথে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন তিনি। কর্মজীবনে তিনি গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন তিনি।
শৈশব : মো. আব্দুর রহমান স্যারের এর বাবার যখন বয়স ৬ বছর তখনই তার দাদা মারা যান। পরে তার বাবা মফিজ উল্ল্যাহ মা ও বড় ভাইদের কাছে বড় হন। মফিজ উল্ল্যাহ তার বাবা’র কৃষি জমির আয়ের উৎস দিয়ে পরিবার চালাতেন। তিনি খুবই স্নেহ পরায়ন ও সাদামাটা কৃষক ছিলেন। তিনি সব সময় বলতেন আমার ছেলে আব্দুর রহমান মেধাবী ও সৎ মানুষ হবে। বাবার কৃষি নির্ভর অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিলো না। যখন তার বড় ছেলে আসান উল্ল্যাহ’র চাকুরী হয়েছে তখনই সংসারে আয়ের উৎস বেড়েছে।
আব্দুর রহমানের বয়স যখন ৪ বছর তখন তাঁর বাবা মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনের জন্য ভর্তি করে দেন। সেখান থেকে কোরআন শিক্ষা লাভ করেন তিনি। ৫ বছর বয়সে ১৯৫৭ সালে রিচি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। সেখানে সফলতার সাথে ৫ম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ওই স্কুলে ছুরুক আলী ও তালিব হোসেন স্যারের কাছ থেকে থেকে শিক্ষা গ্রহন করেন। পরবর্তীতে তালিব হোসেন স্যার বদলী হওয়ায় ছুরুক আলী কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহন করেন তিনি।
পরবর্তীতে ১৯৬১ সালের ১৯ জুলাই আবারও হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। সেখানে সৈয়দ মোবাশ্বির আলীর তার ক্লাস টির্চার ছিলেন। তার কাছ থেকে বাংলা, অংক, ইংরেজি ও বিজ্ঞান শিখেছেন।
ওই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে তিনি কুমিল্লা বোর্ডের অধীনস্থ এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি সরকারি বৃন্দাবন কলেজ হবিগঞ্জ এ ভর্তি হয়ে ১৯৭২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৬ সালে একই কলেজ থেকে তিনি সফলতার সাথে বিএসসি পাশ করেন। তিনি যখন স্কুলে আসা-যাওয়ায় প্রতিদিন ৬/৭ মাইল জায়গা খালি পায়ে হেটে আসতেন। তার সাথে রিচি গ্রামের বাসিন্দা প্রাক্তন শিক্ষা সচিব মরহুম সৈয়দ আতাউর রহমানসহ আরো ২০/২৫ জন ছাত্র এক সাথে আসতেন। পাকা রাস্তা না থাকায় খালি পায়ে বর্ষা মওসুমে লুঙ্গি পড়ে স্কুলে আসতেন আর শুকনো মওসুমে পাজামা পড়ে স্কুলে আসতে হতো তাকে। স্কুলে আসার সময় তার বাবা তাকে কোন টাকা পয়সা দিতেন না। তিনিও বাবার কাছে টাকা চাইতেন না। দুপুরে স্কুলে সিঙ্গারা, খাজা টিফিন দিতো তা খেয়ে তিনি ক্লাসের সময় কাটাতেন। বাড়িতে যাওয়ার পর বন্ধু বান্ধবের সাথে খেলাধুলা করতেন। রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ায় বসতেন। তিনি যখন পড়তে বসতেন তখন তারা মা-বাবা নজরধারী করতেন, তিনি পড়ছেন কি-না। এসএসসি পরীক্ষার পূর্বে মাত্র ২৫ দিন তিনি উচ্চতর বিজ্ঞান একজন শিক্ষকের কাছে পড়েছেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর প্যান্ট ও শার্ট পড়েছেন।
বিদ্যালয়ের জন্য যত কিছু : তখনকার সময় জেকে এন্ড এইচকে উচ্চ বিদ্যালয়ের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। তিনি দয়িত্ব গ্রহণ করার থেকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ও গুণগত মান বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে যখন প্রধান শিক্ষকের পরীক্ষা দিয়েছিলেন তখন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির কয়েকজন সদস্য তাকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিতে বাধা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার যোগ্যতায়ই প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। প্রধান শিক্ষকতার জীবনে বিদ্যালয়ের ২টি বিল্ডিং নির্মান ও ইংরেজী, গণিত, বিজ্ঞান, ধর্মীয় বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ হয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ছিলেন অময়িক ভদ্র, কর্তব্যপরায়ন। শ্রদ্ধেয় আব্দুর স্যার প্রধান শিক্ষক পদে ১৯ বছর সত্যতা নিষ্টার সাথে দায়িত্ব পালন করে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন।
এই শিক্ষকের ছাত্ররা : একটি মোমবাতি যেমন নিজে পুড়ে অন্যের পথ প্রদর্শন করে ঠিক তেমনি আব্দুর রহমান স্যার নিজের যোগ্যতা, সময় ও শ্রম দিয়ে শিক্ষার্থীদের পথ দেখিয়েছেন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. আব্দুর রহমান স্যারের ছাত্রদের মধ্যে ডাক্তার, প্রফেসর, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন দয়িত্বশীল পদে কর্মরত আছেন।
এই শিক্ষকের যত সহপাঠী : আব্দুর রহমান স্যার হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অধ্যায়নকালীন সময়ে সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ আতাউর রহমান (প্রাক্তণ সচিব শিক্ষা মন্ত্রণালয়), এমবিবিএস ডাক্তার গৌরপদ রায়, বিজয় কুমার, রজতপাল ছিলেন।
কঠিন চ্যালেঞ্জ : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. আব্দুর রহমান স্যারের শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবনের প্রতিটি দিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাঠিয়েছেন।
পারিবারিক : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আব্দুর রহমান স্যার ৫ সন্তানের জনক। তার একমাত্র পুত্র মো. আব্দুল্লাহ রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি ব্যবসা করছেন। তার প্রথম কন্যা মেহেরুনেছা মাস্টার্স, ২য় কন্যা নাদিয়া রহামন অনার্স অধ্যায়নকালে আমেরিকা প্রবাসী এক যুবকের সাথে বিয়ে হয়। ৩য় কন্যা সাদিয়া রহমান বিএ ও ৪র্থ কন্যা শাহিদা রহমান অনার্স সম্পন্ন। কন্যাদের মধ্যে শাহিদা রহমান ছাড়া সবাই বিবাহিত।
গুনী এই শিক্ষক ২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশনের জরিপে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সন্মাননা পদকে ভুষিত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, ফাউন্ডেশন হবিগঞ্জ জেলার ৯টি উপজেলার ১৮ জন আদর্শ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে পদক দেয়ার পাশাপাশি তাদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ
(রুহেল)। পদকপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জন শিক্ষককে আর্থিক সহযোগিতাও দেবে সংস্থাটি।
শিক্ষকতায় যেভাবে আসা : আব্দুর রহমান লেখাপড়া শেষ করে দেখলেন তাঁর একটা চাকুরীর প্রয়োজন। তিনি তখন সবদিক হিসেব করে দেখলেন শিক্ষকতা পেশায় যাওয়াই ভালো। তাঁর কাছ থেকে ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহন করে দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশন করবে। এ হিসেবে লাখাইয়ের রাঢ়িশাল করাব উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। তিনি শিক্ষকতা জীবনে স্কুলে আসতে কখনো দেরী করেননি। ক্লাসে কখনো অনাগ্রহ করেননি। কিরি বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীরা যাতে ভালো রেজাল্ট করে এ জন্য ক্লাস শেষ হওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন। তিনি মৃত্যুবরণ করলেও এ শিক্ষকের কাজটি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে জারী বা বেঁচে থাকবে বলে তিনি আশাবাদী। এ শিক্ষকের অনেক ছাত্ররা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। আব্দুর রহমান স্যারের সাফল্য হলো প্রধান শিক্ষক হিসেবে উপজেলায় পর্যায়ে সম্মাননা পেয়েছেন।
অবসর জীবন : যেহেতু তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন এখনো তিনি একটি কিন্ডার গার্ডেনের ছাত্রদের মাঝে পাঠদান করে সময় দিচ্ছেন। শিশুদের মানুষ করার জন্য।
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. আব্দুর রহমান দীর্ঘ ৩৭ বছর পড়াশোনার ক্ষেত্রে নয়, তিনি ছাত্রকে জীবনে চলার পথে পরামর্শ দেন, ব্যর্থতায় পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দেন, সাফল্যের দিনে নতুনলক্ষ্য স্থির করে দেন।
শিক্ষার দর্শন ছিল ভালো ছাত্রছাত্রী ও আদর্শ নাগিরক গড়ে তোলা। ছাত্রদেরকে লেখাপাড়া ও নামাজের প্রতি অনুপ্রানিত করেছেন। তিনি শুধুমাত্র জীবনে সফল হওয়া নয়, কিভাবে একজন ভাল মানুষ হতে হয় তা শেখান। এই শিক্ষকের আগামী পথচলা হোক শান্তির। তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ূ কামনা করি।
লেখক-