করাঙ্গী নিউজ
স্বাগতম করাঙ্গী নিউজ নিউজপোর্টালে। ১৫ বছর ধরে সফলতার সাথে নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করে আসছে করাঙ্গী নিউজ। দেশ বিদেশের সব খবর পেতে সাথে থাকুন আমাদের। বিজ্ঞাপন দেয়ার জন‌্য যোগাযোগ করুন ০১৮৫৫৫০৭২৩৪ নাম্বারে।

শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. আরজু মিয়া, অসচ্ছলতা দমিয়ে রাখতে পারেনি

  • সংবাদ প্রকাশের সময়: সোমবার, ২১ মার্চ, ২০২২
ফয়সল আহমদ রুহেল: আর্থিক সংকটের কারণে লজিং বাড়িতে থেকেছেন। থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে ছাত্রছাত্রীকে সকাল-সন্ধ্যা পড়িয়েছেন। তাদেরকে পড়াতে গিয়ে নিজের পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয় ঘটে। সেই লজিংও চলে যায়। বন্ধ হয়ে যায় পড়ালেখা। বাড়িতে ফিরে থেকেছেন বেকার। সেখান থেকেই বদলে যাওয়া শুরু। কোন মেধাবী মানুষ কখনো কোন বাঁধায় কিংবা শিকলে আটকে থাকেনা। যেমন থাকেনি মো. আরজু মিয়ার জীবন । এই শিক্ষক মিরপুর ফয়জুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক।
 
জন্ম : মো. আরজু মিয়া হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার মিরপুরবাজারের লামাতাশী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। মো. আরজু মিয়ার দুই ভাই, এক বোন ।ভাই বেঁচে নেই ।একমাত্র বোন বেঁচে আছেন। তবে স্বামী দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন ।
 
এই শিক্ষক দুই ছেলে, এক মেয়ের জনক। বড়ছেলে আরিফ আফতাব, জুনিয়র অফিসার-গ্লোবাল ইসলামিক ব্যাংক। বিএসসি (অনার্স), এমএসএস (নৃবিজ্ঞান), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। ২য় আফরোজা সুলতানা বিএ, বিবাহিত। ছোট ছেলে আশরাফ আফতাব ঢাকাস্থ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি (কার্ডিওলজি) এ অধ্যায়নরত।
 
শিক্ষাজীবন : বাড়ির পাশের লামাতাশী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৬৫ সালে লামাতাশী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৭২ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে মিরপুর ফয়জুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে স্টার মার্কসহ প্রথম বিভাগে (বিজ্ঞান) উত্তীর্ণ হন। মদন মোহন কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ২য় বিভাগে (বিজ্ঞান) পাশ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ১৯৮০ সালে বিএ তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন। রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধীনে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ১৯৮৮ সালে ১ম বিভাগে বি.এড সম্পন্ন করেন। ।
 
শৈশব জীবন :
লামাতাশী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ১৯৬৫ সালে পাশ করে স্থানীয় মিরপুর ফয়জুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ১৯৭১ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। ঐ বছরেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার যুদ্ধকালীন অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষা নেয়। ঐ পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ডিসেম্বর দেশ শত্রু মুক্ত হলে বাংলাদেশ সরকার ঐ পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে এবং ১৯৭২ সালের এপ্রিলে মোট ৩০০ নম্বরের সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পুনরায় এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ওই পরীক্ষায় স্টার মার্কসহ ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
 
তারপর সিলেট মদন মোহন কলেজে ভর্তি হন। আর্থিক সংকট থাকায় শহরতলীর একটি গ্রামে লজিংয়ে থাকেন। সকাল-সন্ধ্যা ৬/৭ জন ছাত্রছাত্রীকে পড়িয়ে আরজু মিয়া পড়ার সময় পেতেন না। ফলে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয় ঘটে। সেসময় ২য় বিভাগে পাশ করেন। অত:পর পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স করার জন্য এমসি কলেজে ভর্তি হন। একদিন, মাত্র ক্লাস করার পর ঘরে ফিরে দেখেন লজিং বাতিল হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে পড়ালেখা ছাড়তে হয়। বাড়িতে ফিরে আসেন। ১৯৭৫ সাল বেকার থাকার পর ১৯৭৬ সালে মিরপুর ফয়জুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ে তৎকালীন সর্বনিম্ন জুনিয়র শিক্ষক পদে যোগদান করেন। অত:পর ১৯৮০ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বিএ পাস করার পর সহকারী শিক্ষক পদে উন্নীত হন। ১৯৮৮ সালে বি,এড করার পর সিনিয়র শিক্ষক পদ লাভ করেন। অত:পর ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হয়ে প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হন। শিক্ষকতায় থাকা অবস্থায় কয়েক বার শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে ম্যানেজিং কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। উল্লেখ্য যে, উপজেলা শ্রেষ্ট শিক্ষক হিসেবে তাঁকে ঘোষণা দেওয়া হয়।
 
পরীক্ষক জীবন :
সমম্ভবত ১৯৯১-৯২ সালে ১ম কুমিল্লা বোর্ডের বাংলা ২য় পত্র পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ২-৩ বছর বাংলা ২য় পত্রের পরীক্ষক থাকার পর ইংরেজী ১ম পত্রের পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তারপর সিলেট শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৫-১৬ বছর পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর শেষে প্রধান পরীক্ষক হিসেবে এসএসসি দুই বার এবং জেএসসি দুই বার দায়িত্ব পালন করেন।
 
অবসর :
মিরপুর ফয়জুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পর্যন্ত মোট ৩৮ বছর শিক্ষকতার পর তিনি অবসরে চলে যান। বর্তমানে একটি বেসরকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত আছেন।
গুনী এই শিক্ষক ২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশনের জরিপে বাহুবল উপজেলার আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার পদকে ভুষিত হয়েছেন।
 
উল্লেখ্য, ফাউন্ডেশন হবিগঞ্জ জেলার নয় উপজেলার ১৮ জন আদর্শ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে পদক দেয়ার পাশাপাশি তাদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)। পদকপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জন শিক্ষককে আর্থিক সহযোগিতাও দেবে সংস্থাটি।
 
মো. আরজু মিয়া জীবনের শুরু থেকে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন। এইচএসসি পাসের পর ভেবেছিলাম এখানেই শেষ। আর্থিক দুরবস্থা পোড়ালেও লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহকে দমাতে পারেনি।
শিক্ষকতার পাশাপাশি চালিয়েছিলেন লেখাপড়া। অভাবের সংসারে বেড়ে উঠা এই মানুষটি নিজ সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন। ৩৮ বছর শিক্ষকতা জীবনে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. আরজু মিয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলিয়ে দেন জ্ঞানের আলো। আসলে সত্যিকারের মেধাকে আর্থিক অসচ্ছলতা দমিয়ে রাখতে পারে না। তারই উদাহরণ শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. আরজু মিয়া । আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো সংবাদ