করাঙ্গী নিউজ
স্বাগতম করাঙ্গী নিউজ নিউজপোর্টালে। ১৫ বছর ধরে সফলতার সাথে নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করে আসছে করাঙ্গী নিউজ। দেশ বিদেশের সব খবর পেতে সাথে থাকুন আমাদের। বিজ্ঞাপন দেয়ার জন‌্য যোগাযোগ করুন ০১৮৫৫৫০৭২৩৪ নাম্বারে।

মৌলভী মো. মহি উদ্দিন স্যার শেষ বয়সে থাকেন অন্যের বাসায়

  • সংবাদ প্রকাশের সময়: শনিবার, ১৯ মার্চ, ২০২২
ফয়সল আহমদ রুহেল:

ছাত্রজীবনে লজিং বাড়ির ছাত্র-ছাত্রী পড়াতেন, বিনিময়ে থাকা-খাওয়া ফ্রী। সকাল-সন্ধ্যা ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে গিয়ে নিজের পড়ার সময়টুকুও পেতেন না। আট আনার কেরোসিন কিনে হারিকেন ভরে শেষ রাতে উঠে পড়তে হতো।  হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার ১০নং দেবপাড়ার বাসিন্দা এই গুণী মানুষটি ভালো নেই। এক বছরের বেশি সময় ধরে অসুস্থ। আর এই মানুষটি হলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মৌলভী মো. মহিউদ্দিন স্যার। মোল্লা স্যার নামে সবার কাছে পরিচিত। তিনি নবীগঞ্জ হীরা মিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহকারী শিক্ষক।

জন্ম : মৌলভী মো. মহি উদ্দিন ১৯৬০ সালের ১ লা মার্চ হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার ১০নং দেবপাড়া ইউনিয়নের হরিধরপুরের কালাভরপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শাহ মো. বাদশা মিয়া, মাতা মর্তুজা বিবি। এই শিক্ষকের ২ ভাই এবং এক বোন। পিতা-মাতার তিন সন্তানের মধ্যে শিক্ষক দ্বিতীয়। আর অন্য ভাই-বোন  লেখাপড়া করেননি।

শিক্ষাজীবন : মো. মহি উদ্দিন কালাভরপুর ২নং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর ইত্তেফাকিয়া মাদ্রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৭৩ সালে দাখিল (এসএসসি) পাশ করেন। ১৯৭৪ সালে মৌলভীবাজার টাউন সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে আলিম বর্তমানে (আই,এ), তারপর ১৯৭৭ সালে এফ,এম (ডিগ্রি) পাশ করেন।

শিক্ষকতা : মৌলভী মো. মহি উদ্দিন স্যার নবীগঞ্জের হীরা মিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৭৯ সালের ১ জুন চাকরীতে যোগদান করেন। দীর্ঘ ৪০ বছর ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর সহকারী শিক্ষক হিসেবে থাকাবস্থায় ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি চাকুরী থেকে অবসরে চলে যান।

শৈশব : মো. মহি উদ্দিন স্যার তাঁর মায়ের প্রেরণায় কালাভরপুর ২নং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।  সেখান থেকে ৫ম শ্রেণী পাশ করে তাঁর মায়ের একান্ত ইচ্ছা মহিউদ্দিন যেন মাদ্রাসায় পড়া লেখা করে। সেই সুবাদে নয় মৌজা ইত্তেফাকিয়া মাদ্রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে ১৯৭৩ সালে দাখিল (এসএসসি) পাশ করেন। এররপর ১৯৭৪ সালে মৌলভীবাজার টাউন সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে আলিম বর্তমানে (আইএ), তারপর ১৯৭৭ সালে এফ,এম (ডিগ্রি) পাশ করেন। লেখাপড়া মনযোগ থাকার পর আর্থিক অভাব-অনটনের কারনে উচ্চশিক্ষা ডিগ্রি লাভ করতে পারেননি।

ছাত্রজীবনে মহিউদ্দিন লজিংয়ে থেকে গৃহকর্তার ছেলে-মেয়েকে পড়ার দায়িত্ব পালন করেন। তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যা পড়াতে গিয়ে নিজের পড়ার সময় পেতাম না। আট আনার কেরোসিন কিনে হারিকেন ভরে শেষ রাতে উঠে পড়তে বসতেন। ফজরের নামাজ পড়ে কিছু সময় ঘুমাতেন। ১৯৭৮ সালে একবার রচনা প্রতিযোগিতা হয় দ্বিতীয় বিষয় ‘ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থনীতি কাঠামো’ মৌলভীবাজারের কলেজের ছাত্রছাত্রী ও পিটিআইয়ের শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় মৌলভীবাজার সিড্রেন পার্কে। এই প্রতিযোগিতার ফলাফল জানার জন্য গিয়েছিলেন। তৎকালীন মহকুমার প্রশাসক সাহেব ফলাফল ঘোষণা করেন সেই প্রতিযোগিতায় মহিউদ্দিন ১ম স্থান অধিকার করেন। সেই সময় দুই হাজার টাকা পান। সে সময় এক কিয়ার জমির মূল্য ছিল এক হাজার পাঁচশত টাকা। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ১৯৭৮ সালে রচনা প্রতিযোগিতায় মহিউদ্দিন দ্বিতীয় স্থান লাভ করে ভারতে গিয়েছিলেন।  সেখান থেকে তিনি অনেক পুরস্কার লাভ করেন। তারপর বাড়িতে চলে আসেন।

একদিন নবীগঞ্জে বেড়াতে আসেন মহিউদ্দিন। রাইয়ারপুর বড় বাড়ির ডাক্তার মিম্বর রহমান চৌধুরী মহিউদ্দিনকে বলেন, ভাতিজা আমরা নতুন একটি গার্লস হাইস্কুল করতেছি। আমার স্কুলে তুমি ঢুকতে হবে। সেই হীরা মিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি ১৯৭৭ সালে স্থাপিত হয়। সেই গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চারু চন্দ্র দাশ আর কমিটিতে যারা ছিলেন ডাক্তার মিম্বর রহমান চৌধুরী, সুরেন্দ্র চন্দ্র রায়, ডা. আব্দুল জব্বার , দাতা সদস্য আব্দুল মন্নাফ, আব্দুস সুবহান। ১৯৭৯ সালের ২৮ মে মহিউদ্দিনের লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেই সময়ে সুনামের সহিত তিনি পাশ করেন। থানার সার্কেল অফিসার জনাব লুকমান মিয়া সিও এবং প্রধান শিক্ষক খুশি হয়েছিলেন।

এরপর নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। মহিউদ্দিন ১৯৭৯ সালের ১ জুন চাকরীতে যোগদান করেন। জুন মাসে শেষে সেলারি ২শ’ টাকা পান। ১ জুলাই বৃহস্পতিবার সেই টাকা পেয়ে বাবা-মা’র জন্য একটি কালিয়ারা মাছ ক্রয় করেন ১২ টাকায়। বর্তমানে বাজার মূল্য ৮০০-১০০০ টাকা হবে। মৌলভী মহিউদ্দিন স্যার শিক্ষকতা জীবনে বেশীরভাগ সময়ে পাঠাগারে সময় কাটাতেন। তৎকালীন সময়ে মৌলভীবাজার থাকাকালীন সময়ে পত্র-পত্রিকা ৩-৪টি পড়তেন। বেশির ভাগ সময়ে কলাম পড়তে তাঁর ভালো লাগতো। চাকুরী কালীন সময়ে বাড়ি থেকে আসতেন লুঙ্গি পরে পায়ে হেঁটে। এভাবে ১৬ বছর স্কুলে যাওয়া আসা করেছেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৫ সালের ১৪ আগষ্ট নবীগঞ্জে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ৫শ’ টাকা ঘর ভাড়ায় উঠেন। তিনি ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি চাকুরী থেকে অবসরে যান।

পারিবারিক : মৌলভী মহিউদ্দিন স্যার দুই মেয়ে এক ছেলের জনক। বড় ছেলে ইন্টার পাশ করেছে। আর ২য় মেয়ে এসএসসি পাশ করেছে। ছোট মেয়ে নুসরাত জাহান মিতা নবীগঞ্জ সরকারী কলেজ থেকে অনার্সে ১ম স্থান লাভ করেছে। সে বর্তমানে নবীগঞ্জ পৌর আইডিয়াল হাইস্কুলে শিক্ষিকা হিসাবে কর্মরত আছে।

দায়িত্ব পালন : মৌলভী মহিউদ্দিন স্যার শিক্ষকতা থাকাকালীন কুমিল্লা ও সিলেট বোর্ডের পরীক্ষক ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে এক নাগাদে ২২ বছর পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করেন। এতে কোন ভুলভ্রান্তি ছিল না। একসময় নবীগঞ্জ শিক্ষক সমিতির সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি অত্যন্ত সুনামের সহিত। ৩২টি হাইস্কুলের শিক্ষকরা তাঁকে নির্বাচিত করেন। সেই সমস্ত শিক্ষকরা যারা ভোট দিয়েছিলেন তাদের জন্য এখনও দোয়া করেন তিনি।

ভুলে যায়নি ছাত্রীরা : সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সামাজিকীকরণ করতে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। তাই, একজন শিক্ষক অবসর নেওয়ার পরও ছাত্রীরা ভুলে যায়নি শিক্ষকের ভালোবাসা ও বদান্যতার কথা। এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহিউদ্দিন ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্রেইন স্টোক হয়। এই সংবাদ তাঁর ছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তখন স্যারের কাছে কোন টাকা পয়সা ছিল না চিকিৎসা করার মত। স্যারের পুরাতন ছাত্রীরা লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ছিল। সেই সমস্ত ছাত্রীরা সবাই কিন্তু তাদের নিজ উদ্যোগ টাকা সংগ্রহ করে মহিউদ্দিন স্যারের চিকিৎসার ব্যবস্থা তারা করেন। সাবেক ছাত্রীরা এমন মহৎ কাজ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ছাত্রী শিক্ষক যে সম্পর্ক তা দুনিয়ার মানুষকে জানিয়ে দেন তারা।  নাম না জানা অনেক ছাত্রীরা আছে তাদের জন্য মহিউদ্দিন স্যার নামাযান্তে সব সময় দোয়া করেন। চাকুরী কালীন সময়ে মাথা রাখার একটু জায়গাও করতে পারেননি। বর্তমানে ভাড়া বাড়িতে থাকেন এই গুণী শিক্ষক।

বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় দিনযাপন করছেন। আয়ের কোন উৎস নেই, নবীগঞ্জে এক শতক জায়গাও নেই। বর্তমানে তিনি শূন্যের উপর বসবাস করছেন। ২০২১ সালে অসুস্থ অবস্থায় দেশি-বিদেশী ছাত্রীরা তাঁকে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করেছে তাদেরকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলতে পারবেন না। এই শিক্ষক বলেন, প্রত্যেক সময় তাদের কথা মনে পড়ে। মানুষের ইতিহাসে লেখা না থাকলেও সোনার অক্ষরে আল্লাহর ডায়েরিতে তাদের নাম লেখা থাকবে। তাঁর দুর্দিনে বর্তমান ও পুরাতন ছাত্রীরা শিক্ষকের জন্য অভাবনীয় পরিশ্রম করেছে তাদের জন্য সময় সময় কোরআন তেলাওয়াত করে দোয়া করেন তিনি।

গুনী এই শিক্ষক ২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্টিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশনের জরিপে নবীগঞ্জ উপজেলার আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার পদকে ভুষিত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, ফাউন্ডেশন হবিগঞ্জ জেলার নয় উপজেলার ১৮ জন আদর্শ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে পদক দেয়ার পাশাপাশি তাদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)। পদকপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জন শিক্ষককে আর্থিক সহযোগিতাও দেবে সংস্থাটি।

লেখাপড়া মনযোগ থাকার পর আর্থিক অভাব-অনটনের কারনে উচ্চশিক্ষা ডিগ্রি লাভ না করা এই মানুষটি অন্যায়ভাবে আয় করেননি একটি টাকাও। অথচ সেই তিনি আজ কষ্টের সাগরে ডুবে আছেন।
মৌলভী মহিউদ্দিন স্যার দরিদ্র্রতার কাছে হার মেনে নিতে দেননি। পদে পদে ডিঙ্গিয়েছেন সব প্রতিকূলতাকে। মৌলভী মহিউদ্দিন স্যার ধূলো-বালি-কাঁদা-রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে লুঙ্গি পরে হেঁটে স্কুলে আসা-যাওয়া করতেন। এভাবে ১৬ বছর স্কুলে যাওয়া আসা করেছেন। এর মধ্যে কত কাল গত হয়ে গেছে।  শিক্ষকের বড় একটি মাত্র ছেলে। সেও দীর্ঘদিন যাবত মানসিক-শারীরিক রোগে ভুগতেছে। এতো কিছুর পরও দুই মেয়েকে সুশিক্ষকায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন তিনি। ৪০ বছর চাকরী জীবনে মাথা গোঁজার একটুও জায়গা করতে পারেননি মৌলভী মহিউদ্দিন স্যার। শেষ বয়সে ভাড়া বাড়িতে থাকেন অন্যের বাসায়। শিক্ষকতা পেশাকে নেশায় পরিণত করেছিলেন তিনি। মানুষের ভালোবাসায় জীবন সিক্ত হয়েছেনসএটাই তাঁর জীবনের পরম প্রাপ্তি । আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো সংবাদ