শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ০৭:২৩ অপরাহ্ন
ফয়সল আহমদ রুহেল: একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কম নয়। একজন শিক্ষকের কিছু কাজ ও দায়বদ্ধতা আছে। এই দায়বদ্ধতা থেকে জীবনের যৌবনকালে শিক্ষকতা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো জ্বালানো ।শিক্ষকতা জীবনে নীতি নৈতিকতার শিক্ষা। কখনো দুর্নীতি, অন্যায় এবং অনৈতিকতার আশ্রয় না দেয়া। সমাজকে উপহার দেয়া অনেক কীর্তিমান। মানুষ গড়ার কারখানায় জীবনের স্বর্ণালী সময়টা কাটিয়ে দেওয়া সেই মানুষটি হলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আলহাজ¦ মো. জবেদ আলী স্যার। তিনি হবিগঞ্জ সদরের পইল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক (অব.)।
জন্ম : শিক্ষানুরাগী আলহাজ¦ মো. জবেদ আলী ১৯৪৬ সালের ২ জুলাই হবিগঞ্জ জেলা সদরের সুঘর গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত আইয়ুব আলী, মাতা মৃত ইয়ারম চান বিবি। আলহাজ¦ মো. জবেদ আলী ৩ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।
শিক্ষা : মো. জবেদ আলীর শিক্ষার প্রথম হাতেখড়ি সুঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এখান থেকেই ১৯৫৯ সালে প্রাইমারী শিক্ষা শেষ। এরপর ১৯৬৫ সালে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক শাখায় ৩য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে হবিগঞ্জের বৃন্দাবন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় বাণিজ্য শাখায় ৩য় বিভাগ অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে একই কলেজ থেকে স্নাতক (বাণিজ্য) ৩য় বিভাগে পাশ করেন। এছাড়া ১৯৮৫ সালে বিএড ফেনী টিচার্স কলেজ থেকে উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন।
কর্মজীবন : আলহাজ¦ মো. জবেদ আলী বাগাউড়া জুনিয়র হাইস্কুল, নবীগঞ্জ, প্রধান শিক্ষক পদে ০১.০১.১৯৭০ ইং হতে ১৯.০৬.১৯৭১ ইং পর্যন্ত ১ বছর ৫ মাস ১৮ দিন কর্মরত ছিলেন। এরপর ফয়জুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়, মিরপুর, বাহুবল, সহকারী শিক্ষক পদে ১৫.০৭.১৯৭১ ইং হতে ৩১.০৫.১৯৮৫ ইং পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ বছর ১০ মাস ১৭ দিন শিক্ষকতা করেন। দ্বিমুড়া রহমানিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, বাহুবল, সহকারী শিক্ষক পদে ১.৬.১৯৮৫ ইং হতে ০৩.১২.১৯৮৫ ইং পর্যন্ত ৬ মাস ৩ দিন শিক্ষকতা করেন। ফয়জাবাদ জুনিয়র হাইস্কুল, বাহুবল, প্রধান শিক্ষক পদে ৫.১২.১৯৮৫ ইং হতে ৩১.০৫.১৯৮৬ ইং পর্যন্ত ৫ মাস ২৭ দিন দায়িত্ব পালন করেন। মিরপুর বালিকা জুনিয়র হাইস্কুল, বাহুবল, প্রধান শিক্ষক পদে ১.০৬.১৯৮৬ ইং হতে ৩১.০৭.১৯৮৭ ইং পর্যন্ত ১ বছর ২ মাস দায়িত্ব পালন করেন। পইল উচ্চ বিদ্যালয়, পইল, হবিগঞ্জ, সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে ০১.০৮.১৯৮৭ ইং হতে ০১.০৭.২০০৬ ইং পর্যন্ত। চাকুরীকাল দীর্ঘ ১৮ বছর ১১ মাস।
উল্লেখ্য, আলহাজ্ব মো. জবেদ আলী বিভাগীয় বিধি মোতাবেক ০১.০৭.২০০৬ ইং পইল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ হতে অবসর গ্রহণ করে পুনরায় ০২.০৭.২০০৬ ইং হতে ৩১.১২.২০১০ ইং পর্যন্ত ৪ বছর ৬ মাস নন এমপিভূক্ত (সরকারী বেতন ছাড়া) বিদ্যালয়ে প্রদত্ত বেতনে চাকুরী করেন। মোট চাকুরী কাল ৩৬ বছর ৫ মাস ৫ দিন (এমপিওভুক্ত শিক্ষক)। পইল উচ্চ বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত ৪ বছর ৬ মাস শিক্ষকতা করেন (নন এমপিওভূক্ত)। সর্বমোট চাকুরিকাল ছিল ৪০ বছর ১১ মাস ৫ দিন। সর্বশেষ পইল উচ্চ বিদ্যালয়ে সরকারী বেতনসহ ১৮ বছর ১১ মাস চাকুরি করে অবসরে চলে যান তিনি। অতিরিক্ত একই স্কুলে সরকারি বেতনবিহীন বিদ্যালয়ের প্রদত্ত বেতনে ৪ বছর ৬ মাস চাকুরি করেন।
পরীক্ষক : পইল উচ্চ বিদ্যালয়, পইল, হবিগঞ্জ এ চাকুরি কালীন সময়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, কুমিল্লা এর এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজী বিষয়ের পরীক্ষক ছিলেন আলহাজ¦ মো. জবেদ আলী।
শিক্ষা জীবনের কিছু তথ্য : আলহাজ্ব মো. জবেদ আলী সুঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৫৫ সালের ১ জানুয়ারি প্রাথমিকের হাতেখড়ি। এরপর এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। মাধ্যমিক-মানব কল্যাণ জুনিয়র হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণী ১৯৬০-১৯৬২ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ ৯ শ্রেণী-১০ম শ্রেণী ১৯৬৩-১৯৬৪ ইং পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন। ওই বিদ্যালয় থেকে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ১৯৬৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক শাখায় ৩য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। একই বোর্ড থেকে ১৯৬৭ সালে বৃন্দাবন কলেজ, হবিগঞ্জ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বাণিজ্য শাখায় ৩য় বিভাগে পাশ করেন। স্নাতক (বাণিজ্য) বৃন্দাবন কলেজ, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৭০ সালে ৩য় বিভাগে পাশ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে ফেনী টিচার্স কলেজ, ফেনী থেকে বিএড উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন।
মসজিদ নির্মাণ : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আলহাজ্ব মো. জবেদ আলী শিক্ষকতার পাশাপাশি একজন সমাজসেবক হিসেবে এলাকায় সমাদৃত ছিলেন। তিনি পইল উচ্চ বিদ্যালয়, পইল, হবিগঞ্জ হতে অবসর গ্রহণের পর অবসরকালীন সময়ে সরকার কর্তৃক কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার টাকা। তিনি বসতবাড়ির পূর্ব দিকে উত্তরে দক্ষিণে যাতায়াতের ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক নির্মিত রাস্তার পশ্চিম পাশে নিজস্ব জায়গায় এক লক্ষ টাকা ব্যয়ে এলাকার জনগণের পবিত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুম্মা এর নামাজ আদায়ের জন্য একখানা মসজিদ নির্মাণ করেন।
জ্বালিয়েছেন শিক্ষার আলো : আলহাজ্ব মো. জবেদ আলী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শুধু শিক্ষকতা করেননি প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্বালিয়েছেন শিক্ষার আলো। সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি বিদ্যালয়। তিনি ১৯৯০ সালে হবিগঞ্জ জেলাধীন বাহুবল উপজেলার ৫নং লামাতাশী ইউনিয়নের ভুলকোট গ্রামে ‘আদর্শ বিদ্যা নিকেতন ভুলকোট’ নামীয় বিদ্যালয়টি এ শিক্ষকের নিজ খরিদা ৮২ শতক ভূমি হতে ৭১ শতক ভূমি বিদ্যালয়ের নামে রেজিষ্ট্রি দলিল মূলে দান করে বিদ্যালয়ের নামে নামজারি করেন। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিতে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পদে বহাল আছেন আলহাজ¦ মো. জবেদ আলী। বিদ্যালয়টি ১৯৯৮ সনের এপ্রিল মাস হতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক এমপিওভূক্ত। ২০০৩ সাল হতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড সিলেটের অধীনে মানবিক, বিজ্ঞান, বাণিজ্য শাখায় ছাত্রছাত্রীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সুনামের সাথে ফলাফল অর্জন করে আসছে। দিন দিন ছাত্রছাত্রীর সংখা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ৫১৪ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করিতেছে।
পারিবারিক : আলহাজ¦ মো. জবেদ আলী ২ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ১ম ছেলে নজরুল ইসলাম-ব্যবসী। নজরুল ইসলামের স্ত্রী মোছা. শরিফা বেগম হবিগঞ্জ জেলার উত্তর চরহামুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত আছেন। ২য় ছেলে মো. রুবেল আহমেদ হবিগঞ্জের বাহুবল কলেজে প্রভাষক হিসেবে চাকুরিরত। ১ম মেয়ে মোছা. সাজেদা বেগম ও ২য় মেয়ে মোছা. জোৎস্না বেগম উভয় বিবাহিত।
গুনী এই শিক্ষক ২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশনের জরিপে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার পদকে ভুষিত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, ফাউন্ডেশন হবিগঞ্জ জেলার নয় উপজেলার ১৮ জন আদর্শ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে পদক দেয়ার পাশাপাশি তাদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ ( রুহেল )। পদকপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জন শিক্ষককে আর্থিক সহযোগিতাও দেবে সংস্থাটি।
শিক্ষার আলো বিলিয়ে তৃপ্তি পান আলহাজ্ব মো. জবেদ আলী স্যার। এরই লক্ষ্যে শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৯৯০ সালে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নিজ ভূমি দান করেন। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বাহুবল উপজেলার অন্যতম বিদ্যাপীঠ ‘আদর্শ বিদ্যা নিকেতন ভুলকোট’। সেই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য তিনি। যাদের ভালোবাসা, আন্তরিকতা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের বিদ্যালয়টি আজ দিন দিন কৃতিত্ব অর্জন করে চলেছে। সেই কৃতিত্বের অংশীভূত হয়ে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক এবং এলাকাবাসীর হৃদয়ে বেঁচে আছেন এই মহান মানুষটি। সবকিছু ছাড়িয়ে যেটা সবচেয়ে বড় পরিচয় তা হল, তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর। এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ূ কামনা করি।