রবিবার, ১১ মে ২০২৫, ০১:০৬ পূর্বাহ্ন
করাঙ্গীনিউজ: অতিবৃষ্টি আর পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে সিলেট বিভাগে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। গতকাল শনিবার সারাদিন বৃষ্টিপাত ও দমকা হাওয়া অব্যাহত ছিল। বিভাগের সবক’টি নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ডুবে গেছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও হাসপাতালসহ নানা স্থাপনা পানির নীচে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেট বিভাগে বড় ধরণের বন্যার আশংকা করা হচ্ছে। বন্যার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৫ শতাধিক প্রাইমারী স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা।
এদিকে সিলেটে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সিলেট শহরের অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায়ও পানি প্রবেশ করেছে। নগরীর উপশহর, তের রতন, ছড়ারপার, শেখঘাট, কলাপাড়া, ঘাসিটুলা ও শামীমাবাদ এলাকার রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অনেক স্থানে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। সিলেটের আবহাওয়াবিদ সাইদ আহমদ চৌধূরী জানিয়েছেন, আগামী ২০ জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সিলেট বিভাগের সবক’টি নদীর পানি গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবধরণের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী প্রেরণ করা হয়েছে।
আমাদের কোম্পানীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে উপজেলার নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। শুক্রবারের চেয়ে শনিবার (১৩ জুলাই) এক ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ধলাই ও পিয়াইন নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার্ত মানুষজন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। গো-খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। লোকজনের চলাচলের এক মাধ্যম নৌকা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজেন ব্যানার্জী জানান, বন্যা মোকাবেলায় সব ধরণের প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। লোকজনকে আতংকিত না হওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। ছয়টি ইউনিয়নের বন্যার্ত লোকজনের মাঝে ত্রাণ বিতরণের জন্য আট টন চাল বরাদ্ধ করা হয়েছে।
আমাদের গোয়াইনঘাট প্রতিনিধি জানান, গত চারদিন ধরে অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে গোটা উপজেলা বানের পানিতে ভাসছে। জেলা সদরের সাথে উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শনিবার বিকেল থেকে আবারও পানি বাড়তে শুরু করেছে।
সিলেটের ভারপ্রাপ্ত ডিসি, এডিসি ও ইউএনও লেঙ্গুড়া ইউপির বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করেছেন। শনিবার আরও ১৬ মে. টন চাল ও ২ শ’ পেকেট শুকনো খাবার এসেছে বলে ত্রাণ অফিস জানিয়েছেন। শুক্রবার ১৮ মে.টন বিতরণ করা হয়। দু’লাখ পানিবন্দী মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন গ্রামে দূর্গতরা ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
আমাদের জকিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জকিগঞ্জে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে ও জমির উঠতি ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে উপজেলার বারহাল ইউনিয়ন। শুক্রবার গভীর রাতে বারহাল ইউনিয়নের নূরনগর ও মহিদপুর গ্রামে সুরমা ডাইকে ভাঙ্গন দেখা দেয়ায় প্রবল বেগে পানি ঢুকে নদী তীরবর্তী এলাকার প্রায় শতাধিক বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যায়। এতে প্রায় শতাধিক পরিবারের লোকজন গৃহহারা হয়ে পড়েছেন।
৯ নং ইউপি ওয়ার্ডের সদস্য সুমন আহমদ চৌধুরী জানান, শুক্রবার গভীর রাতে বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতে পাই নুরনগর ও মহিদপুর গ্রামের সুরমা ডাইকে ভাঙ্গন দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। সঙ্গে সঙ্গে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় পানিবন্দি লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেই।
বারহাল ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী জানান, ইউনিয়নের নিজগ্রাম, চক ও পুটিজুরি এলাকার সুরমা ডাইকের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ইউনিয়নের প্রায় বিশটি গ্রাম বন্যা কবলিত।
উপজেলা চেয়ারম্যান লোকমান উদ্দিন চৌধুরী জানান, বীরশ্রী ইউনিয়নের পীরনগর এলাকার কুশিয়ারা ডাইক ভেঙ্গে পানি ঢুকতে শুরু করলে পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া জকিগঞ্জ সদর থেকে আমলশীদ পর্যন্ত কুশিয়ারা ডাইকের উপর পানি ছুই ছুই করছে। কাজলশাহ, মানিকপুর, খলাছড়া, বীরশ্রী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিজন কুমার সিংহ বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করছেন। জরুরী ভিত্তিতে ত্রান সামগ্রী প্রেরণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
আমাদের বিশ্বনাথ প্রতিনিধি জানান, গত কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার লামাকাজি ইউনিয়নের সুরমা পাড়ে অবস্থিত মাহতাবপুর, মাধবপুর, শাহপুর, খূজার পাড়া, পূর্ব সোনাপুর, মির্জারগাও ও সাহেবনগর গ্রামের নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট ইতোমধ্যে পানির নীচে তলিয়ে গেছে। বাড়ি ঘরে এখনো পানি ওঠেনি, তবে ছুঁইছুঁই করছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক নজরদারী করা হচ্ছে। ঐ এলাকার নাগরিকদের সাবধানে থাকতে বলা হয়েছে। অবস্থার অবনতি ঘটলে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হবে।
উপজেলার খাজাঞ্চী ইউপি চেয়ারম্যান তালুকদার গিয়াস উদ্দিন বলেন, ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডে পানি প্রবেশ করছে। এলাকায় রোপনকৃত রোপা আমনের চারা তলিয়ে গেছে।
লামাকাজি ইউপি চেয়ারম্যান কবির হোসেন ধলা মিয়া বলেন, ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে পানি প্রবেশ করছে। বেশিরভাগ গ্রামের মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। এলাকার নিন্মাঞ্চলের রাস্তাঘাটগুলোও তলিয়ে গেছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার রমজান আলী বলেন, এলাকার নিন্মাঞ্চলের আউশ ধান প্রায় ১০ হেক্টর, রোপা আমন বীজতলা প্রায় ২ হেক্টর জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে দুই একদিনের মধ্যে পানি কমে গেলে তেমন ক্ষতি হবেনা। উপজেলা লামাকাজি ও খাজাঞ্চি ইউনিয়ন ছাড়া অন্য কোন ইউনিয়নে ফসলী জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গত ৬ দিন ধরে টানা অবিরাম বৃষ্টিপাত আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের ৭টি উপজেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে গেছে। এখনো এসব উপজেলায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। নতুন নতুন এলাকায় বানের পানিতে সড়কে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। অসংখ্য ঘরে ঢুকে পড়েছে পানি। লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী জীবন যাপন করছেন। মাঠ ঘাট ডুবে যাওয়ায় গবাদী পশুর খাবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। বিশুদ্ধ পানির অভাবে হাওরাঞ্চলে রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। হাওরপাড়ের কৃষকের বীজতলা ডুবে যাওয়ায় সবজী ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড । জেলা শহরের ঘোলঘর, নতুনপাড়া, বনানীপাড়া, নবীনগর, কালিপুর, তেঘরিয়া, আরপিন নগর, হাছন নগর, ওয়াজখালীসহ পৌর শহরের নিন্মাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া জেলার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দোয়ারাবাজার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা ও ধর্মপাশা উপজেলার নিন্মাঞ্চলের কয়েক শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসব উপজেলার বেশিরভাগ সড়ক পানিতে ডুবে গিয়ে জেলা শহরের সাথে উপজেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক জায়গায় ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হওয়ার খবর আসছে।
সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নে ইনাতনগর গ্রামের শেফালী বেগম জানান, ৩ দিন ধরে ঘরে পানি। রান্নাবান্নার কোন ব্যবস্থা নেই। ধর্মপাশা উপজেলার শত শত ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় রান্নাবান্নার কাজ সারতে কলা গাছের ভেলা ব্যবহার করছেন গৃহিণীরা। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের শিমুলবাক ইউনিয়নের ৫/৬টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। খিদিরপুর গ্রামের এম জে কে শাহজাহান জানান, আমাদের গ্রামে চারদিকে পানি। এখনো সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কেউ ত্রাণ সহায়তা দিতে এগিয়ে আসেননি।
জেলা সদরের পাশেই হালুয়ারঘাট সড়কটি বন্যার পানিতে ভেঙ্গে যাওয়ায় কোরবান নগর ইউনিয়নের একাংশ, সুরমা ইউনিয়নের একাংশ, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন এবং দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের একাংশের সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিরুল হক জানান, জেলার ৬’শ ২১টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় আড়াইকোটি টাকা। মৎস্যখামারীরা বড় ধরণের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।
এদিকে সদর উপজেলার সুরমা, জাহাঙ্গীরনগর ও রঙ্গারচর ইউনিয়নের ১০ হেক্টর সবজী ফসলের ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসন জানায়, ৯ টি উপজেলার ১২ হাজার ৮০০ ঘরবাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের তরফ থেকে বন্যার্তদের জন্য ৩ লক্ষ টাকা, ৩শ’ মেট্রিকটন চাল ও শুকনো খাবার প্রদান করা হয়েছে। সরকারিভাবে ১০টি আশ্রয় কেন্দ্র সহ সকল স্কুল গুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল হুদা চপল ও তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে শুকনো খাবার ও চাল বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন।
আমাদের তাহিরপুর প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ীর ঢলের পানিতে বন্দী হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে পানিবন্দী পরিবার গুলোতে। এদিকে বসতবাড়ি হাওরের বড় বড় ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙ্গে যাচ্ছে। গৃহহারা মানুষগুলো আশপাশের বিদ্যালয় কাম বন্যাশ্রয় কেন্দ্রে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।
তাহিরপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিলন কান্তি তালুকদার জানান, উপজেলার শ্রীপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে ৩টি, শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নে ৩টি, বালিজুড়ি ইউনিয়নে ১টি ও বাদাঘাট ইউনিয়নের সাহালা গ্রামে ১টি বন্যাশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
উপজেলার হাওরপাড়ের বিভিন্ন গ্রামগুলোতে দেখা যায়, হাওরের প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে তাদের বসত বাড়ি ভেঙ্গে নিশ্চিহ্ন হবার পথে। তারা পরিবার পরিজন নিয়ে নোয়ানগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম বন্যাশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে কথা হয় ৬৫ বছরের বৃদ্ধ রশিদ মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, বানের পানিতে তার বসতভিটা ভেঙ্গে পড়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় ত্রাণ পাচ্ছেন না।
একই কথা জানালেন নোয়ানগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম-বন্যাশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া শামীম মিয়া ও নাহিদ হাসান কাঞ্চন। ওখানে আশ্রয় নেয়া সবাই উপজেলার শ্রীপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের নোয়ানগর গ্রামের বাসিন্দা।
আমাদের ছাতক প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নতুন-নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বর্তমানে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার, চেলা নদীর পানি বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ও পিয়াইন নদীর পানি ১১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ডাইকি, বটেরখাল ও বোকা নদীর পানিও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে এখানকার দুলাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
ইতোমধ্যে বন্যার পানিতে গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক সড়কের রহমতবাগ এলাকা তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক সড়ক দিয়ে সারাদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় শহরের সাথে গ্রামের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। বাড়ির আঙ্গিনাসহ নিন্মাঞ্চলের অনেক বসতঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে। ঢলের পানি প্রবেশ করায় অন্তত অর্ধশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়েছে।
সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পৌর শহরের অলি-গলি ও বাসা-বাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করায় জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। শহরের কানাখালি সড়ক, ফকিরটিলা-মাছিমপুর বাজার সড়ক, ইসলামপুর ইউনিয়নের ছনবাড়ি-রতনপুর সড়ক, ছনবাড়ি-গাংপাড়-নোয়াকোট সড়ক, কালারুকা ইউনিয়নের মুক্তিরগাঁও সড়ক, বঙ্গবন্ধু সড়ক, রায়সন্তোষপুর সড়ক, আমেরতল-ধারণ সড়ক, পালপুর-খুরমা সড়ক, বোকারভাঙ্গা-সিরাজগঞ্জ সড়কসহ উপজেলার অধিকাংশ সড়কের বিভিন্ন অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ, ছাতক-সুনামগঞ্জ, ছাতক-দোয়ারা ও ছাতক-জাউয়া সড়কের বিভিন্ন অংশের উপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জামুরা, চানপুর, নোয়াগাঁও, ভাসখলা, করচা, গোয়ালগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অর্ধশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। জামেয়া মুহাম্মদিয়া মুক্তিরগাঁও দাখিল মাদরাসা, চরভাড়া মাদরাসা, বৈশাকান্দি এফআইভিডিবি স্কুল, লামাপাড়া ব্র্যাক স্কুলে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে।
জগন্নাথপুর থেকে সংবাদদাতা জানান, জগন্নাথপুরে টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে অকাল বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। কুশিয়ারা ও নলজুর সহ বিভিন্ন নদ-নদী ও হাওরে বেড়ে চলেছে পানি। বন্যার পানিতে উপজেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে গেছে। বিভিন্ন হাট বাজারে ও বাড়িঘরে পানি উঠেছে। তলিয়ে গেছে অনেক রাস্তাঘাট। যে কারণে পানিবন্দী মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
শনিবার সরজমিনে পৌর এলাকা ও উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। রাণীগঞ্জ, বড়ফেছি, স্বাধীন বাজার, পাটকুড়া বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে পানি উঠেছে। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট। এতে অনেক স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে উপজেলার রাণীনগর সহ কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে গেছে। এছাড়া উপজেলার অধিকাংশ নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। পানিবন্দী লোকদের অনেকে উচুঁ এলাকার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেকে আবার নিজ ঘরে বাঁশের মাচা বানিয়ে ঝুকি নিয়ে বসবাস করছেন। তবে গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
মৌলভীবাজার : আমাদের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢলে মৌলভীবাজারের কুশিয়ারা নদী ফুঁসে উঠে গ্রামীন ঘর-বাড়িতে বানের পানি প্রবেশ করেছে। গেল কদিন মনু ও ধলাই নদ-এর পানি কমে গেলেও এখনকার অবিরাম বৃষ্টিতে আবারও পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, মনূ সেতুর চাঁদনীঘাট এলাকায় বিপদসীমার ৩৭ সেঃ মিঃ উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মৌলভীবাজার শহরের মানুষের দুঃশ্চিন্তা যেন কাটতেই চাইছে না। গেল বছর শহরের পাশে বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়াতে এবারো আতঙ্কে আছেন তারা। এদিকে পাউবো জানিয়েছে, শহরের পাশে ঝুঁকিপূর্ণ দুটি জায়গা রয়েছে। মীরপুর ও ঢেউপাশা এলাকার মুহাম্মদপুরের এ দুটি ঝুকিপূর্ণ স্থানে আপাতত বাঁধ দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
এদিকে কুশিয়ারা নদীর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনূমূখ ইউনিয়ন, রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ও ফতেপুর ইউনিয়নের নদীর তীরবর্তী প্রায় ২৫টি গ্রামের ভেতর পানি ঢুকেছে। এতে ওই ভাটি এলাকার সিংহভাগ যাতায়াতের রাস্তা-ঘাট, বাড়ির আঙ্গিনা ও উঠানে পর্যন্ত পানি প্রবেশ করেছে। রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউপির ছিক্কাগাঁও, কামালপুর, আমনপুর, সুরিখাল, যোগীকোনা, কেশরপাড়া, সুনামপুর, উমরপুর, কান্দিগাঁও, জোড়াপুর ও ফতেপুর ইউনিয়েনের সাদাপুর, হামিদপুর, বেড়কুড়ি,শাহাপুর, জাহিদপুরসহ প্রায় ২০-২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্ত্তী শনিবার বিকেলে এ প্রতিবেদককে জানান, মনু রেলওয়ে সেতুতে বিপদসীমার ৮ সেঃ মিঃ নীচে, মৌলভীবাজার শহরের চাদনীঘাট এলাকায় ৩৭ সেন্টিমিটার উপর, ধলাই নদে ১৫ সেঃ মিঃ নীচ ও কুশিয়ারা নদীর শেরপুরে বিপদসীমার ৪৫ সেঃ মিঃ উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
আমাদের কমলগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কমলগঞ্জে গত শুক্রবার দিবাগত রাত ২টার দিকে কমলগঞ্জে ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের পৌর এলাকার রামপাশা এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দেয়। বন্যার পানিতে দুটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ৫ শতাধিক লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। তিনি জানান, রাত ২টার দিকে কমলগঞ্জ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের রামপাশা এলাকায় ধলাই নদীর প্রায় ৭০ ফুট বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। এর ফলে গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। পানি কমে গেলে বাঁধ দ্রুত মেরামত করা হবে। ধলাই নদীর পানিতে ৮, ৯ ও সদর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে পানি প্রবেশ করে রাস্তাঘাট কিছু বাড়ির আঙ্গিনায় পানি উঠেছে। তবে পানি বাড়তে থাকলে মানুষের দূর্ভোগ বাড়বে।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ও পানিবন্দী পরিবারগুলোকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন রামপাশা ও কুমড়াকাপন গ্রামসহ পুরো কমলগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদীর উপর সার্বিক নজরদারি করছে।
ঘটনাস্থলে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা খালিদ বিন ওয়ালিদ বলেন, এ এলাকার প্রতিরক্ষা বাঁধসহ পুরো ধলাই প্রতিরক্ষা বাঁধে পাথরের ব্লক স্থাপনে একটি প্রস্তাব ২ মাস আগে উর্দ্ধতন কর্তপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ প্রস্তাব পাশ হলে প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু হবে। আপাতত শুক্রবার রাতে ভেঙ্গে যাওয়া অংশে মেরামত কাজ করার জন্য একজন ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। পানি কমলে কাজ শুরু হবে।