শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ১০:১৯ অপরাহ্ন
নুরুল আমিন শাহজাহান: ইসলাম যে বিপ্লবী বাণী নিয়ে ৬১০ সালে আরবের মাটিতে হাজির হয়েছিল তাহা তৎকালীন মাত্র এক শতাব্দীর মধ্যেই বিশ্বের মানব সভ্যতার দুই-তৃতীয়াংশ জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলো আরব মুসলিমরা। এর মাঝে তাদের সব চেয়ে বড় ভুমিকা ছিল আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, রাসুল (সাঃ) এর প্রতি ভালবাসা, ত্যাগী মনোভাব, যাযাবর স্বভাব, বাস্তববাদী চিন্তাভাবনা। আরব মোজাহিদ কমান্ডাররা জন্মের পর থেকে যুদ্ধের মাঝেই বড় হতেন। আমাদের মায়েরা যেমন তার সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও সরকারী অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখান, তৎকালীন আরবের মায়েরা তাদের সন্তানকে মোজাহিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। “মোজাহিদ মানে শুধু যোদ্ধা নয়, মোজাহিদ মানে ভিশনারী”। যারা কালেমাকে মানুষের মাঝে পৌঁচানোর জন্য লড়াই করে। অহেতুক মানুষ মারা জিহাদ শব্দের সংজ্ঞায়ই পড়ে না। এই দুর্দান্ত স্বপ্নবাজ মানুষগুলো যখন অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে অর্থ ও প্রাচুর্য্যের বর্ন্যায় ভেসে গেল, তখন থেকেই তাদের মাঝে শহুরে সুশীলতার জন্ম হতে লাগলো। জগতের অর্থ, বিত্ত, ব্যবসা- বাণিজ্য, রাজনীতি সবই তাদের আওতায় এসেছিলো অষ্টম শতাব্দীতেই। কিন্তু যে বিপ্লবী জীবনাদর্শ তাদের মাঝে প্রাচুর্য্য ও সম্মান এনে দিয়েছিল, তা তাদের ধন-সম্পদ ও ভোগ-বিলাসিতার নিচে চাপা পড়তে লাগল। একটা সভ্যতার পতন আসলে এভাবেই হয়। ২/৩ প্রজন্মের মানুষ ভিত্তি গড়ে, ৪/৫ প্রজন্মের মানুষ তা উপভোগ করে। তারপর ধীরে ধীরে ভোগ বিলাসের ফলে তাদের কর্মফল হারিয়ে ফেলে।
ঠিক এমনটাই ঘঠেছিল তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রশিদ্ধ শহর বাগদাদেও।
সয়মটা ছিল ১২৫৮ সাল। তখন খলিফা আল-মোস্তাসিমের দরবার ছিল গান, কবিতা ও গল্পের আড্ডাখানা, তাদের সাথে ছিল দরবারী আলেমরা। তাহারা খলিফার মতের স্বপক্ষে কোরআান-হাদিস থেকে ব্যাখ্যা বের করত। খলিফা ইসমাইলী বনাম আশহারীয়দের মধ্যকার বাহাস বিতর্ক শুনে আনন্দ উপভোগ করতেন। এসব বিষয় নিয়ে বাগদাদের শহর তখন দারুন ভাবে বিভক্ত ছিল। হাজারো মত, হাজারো পথ, হাজারো ফেরকা আছন্ন করে রেখেছিল বাগদাদবাসীকে। যৌক্তিক ভাবে ধর্মীয় বিষয়ে ফায়সালা করার শুভ উদ্দেশ্যে যে বাহাস বিতর্ক শুরু হয়েছিল, কালে কালে সেই বাহাস পরিণত হয়েছিল বিভেদের হাতিয়ার হিসেবে। ‘মাজহাব’ আর ‘ফেরকা’ তাদের এমন ভাবে আছন্ন করে রেখেছিল যে, ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলা ৩৮ বছর যাবৎ মঙ্গোল বিপদকে তারা অনুধাবনই করতে পারেনি।
বাগদাদে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে চারিদিক থেকে আসা মোজাহিদরা অবিহিত করলেও চাটুকার মৌলভীরা সব সময় খলিফা সামনে বাঘের মত গর্জন করে অভয় দিয়ে যেত। খলিফারও তার নিজ নামের গুণ কির্তন শুনতে ভাল লাগত। কথায় বলে-
“যে সমাজের মাথায় পচন ধরে,
তার পতন কে ঠেকাতে পারে”?
মঙ্গোল সম্রাট চেঙ্গিস খানের উত্তরাধিকারী হালাকু খাঁন বাগদাদ জয় করতে আসছে শুনে খলিফা- উলামাদের মতামত চাইলেন। বাঘের গর্জনকারী উলামারা তখন ভেড়ার মত ভেঁ ভেঁ করতে লাগলো। তখন খলিফার বিশ্বস্ত উজির ইবনে আল-খায়েমী জানালেন- মঙ্গোলরা বাগদাদ আক্রমণ করতে চাইলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মোজাহিদরা রক্ষা করতে আসবে। আপনার কোন ভয় নেই। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। তার পরিকল্পনা ছিল বাগদাদকে মঙ্গোলদের হাতে তুলে দিয়ে সমঝোতা করে শিয়া সম্প্রদায়কে রক্ষা করা। তিন লাখের বিশাল বাহিনী নিয়ে যখন হালাকু খাঁন বাগদাদের কাছাকাছি জায়গায় শিবির ফেললেন, তখন উজির আল- খায়েমির পক্ষ থেকে একখানা চিটি ও বিশাল উপহার নিয়ে তিনজন দুত হাজির হল খাঁনের কাছে। খাঁন তিন দুতের মাথা কেটে বস্তায় ভরে ফেরত পাঠালেন উজির ইবনে আল-খায়েমীর কাছে। শুরু হল পৃথিবীর ভয়ংকরতম গণহত্যাদের মাঝে একটি। ২ লাখ থেকে ১০ লাখ মুসলমানকে বিভিন্ন ভাবে হত্যা করল মুঙ্গোল বাহিনী।
খলিফাকে ধরে আনা হল খাঁনের কাছে। আনা হল তার মা, স্ত্রী, কন্যা ও দাসীদের। খলিফার সামনেই মা, স্ত্রী ও দাসীদের গণধর্ষন করে হত্যা করা হল। খলিফা আল-মোস্তাসিমকে কি করা হবে এ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন খাঁন। খলিফা ছিলেন মহানবী (সাঃ) এর উত্তরসুরী। তার রক্ত মাটিতে পড়লে মহা-দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। তাই খাঁচায় আটকে রাখা হল খলিফাকে। এদিকে খলিফাকে হত্যা করার দুচিন্তা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য একদল আলেম হাজির হলেন খাঁনের কাছে। তারা ফতোয়া জারি করলেন – খুদ মহানবী (সাঃ) এর নাতি ইমাম হোসাইনকেও হত্যা করা হয়েছিল। তখনও কিছু হয়নি। খলিফাকে হত্যা করলে কিছুই হবে না। এ কথায় হালাকু খাঁন খুশি হলেও ভয় গেল না ঠিকই। তিনি খলিফাকে হাত-পা বেধে গালিচায় পেঁচিয়ে ১০০ ঘোড়া চালিয়ে দিলেন তার উপর দিয়ে। নৃশংসভাবে হত্যা করা হল খলিফাকে।
অপদার্থ খলিফা আল-মোস্তাসিম ও তেলবাজ আলেমদের মৃত্যুতে জগতের তেমন ক্ষতি না হলেও অপুরন্ত ক্ষতি হয়েছিল মুসলিম জাহানের। যা বিগত ৮০০ বছরেও পূরণ হয়নি।
চিত্রটা আজকের বাংলদেশের মতই অনুরূপ। শিয়া, সুন্নী, ওহাবী, কওমী, সালাফি, আহলে হাদিস, দরবার ও খানকা সহ বিভিন্ন দলে ও গোত্রে বিভক্ত এই দেশ। কিছু স্বার্থন্বেসী উলামা তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে ইসলাম ও সরলমনা মুসলমানদের। বিভিন্ন দল ও ফেরকায় আছন্ন করে দিয়েছে মুসলিমদের। ফলে মুসলমান- মুসলমানদের মাঝে কলহ বিবাদ বেড়েই চলছে দিন ত দিন। ওয়াজ ও জলসা ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্র হলেও তারা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে বরাবরই। এমনকি স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ইসলামী দল সরকারের সাথে আতাত করে অবৈধকেও বৈধ হিসেবে ফতোয়া দিয়ে সুবিধা ভোগ করছে কিছু স্বার্থন্বেসী আলেম। যেমনটা বাগদাদের মতই প্যারালাল। তাহারা লোভ ও মোহের বেড়াজালে পড়ে নিজের অস্থিত্ব বিলীন করে দিয়েছে। “সত্য ও ন্যায়”কে – বিত্ত-বৈবিত্তের চাকার নিচে পিষ্ট করে দিচ্ছে জাগতিক লালসায়। আর তাদের অনুসারীরা লেজুর ভিত্তিক অপরাজনীতির যাতাকলে, দলের স্বার্থে তাদের পেচনে থেকে বাহ্ বাহ্ দিয়ে চলছে। অপরদিকে নাস্তিক, মুরতাদ ও বির্মীরা ইসলামকে ধ্বংস করতে ওঁৎ পেতে থাকলেও এই মহাবিপদ বুঝার মত সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে আলেমরা। মাঝে মাঝে আল্লাহ ও তার নবী (সাঃ) এর অস্তিত্বের উপর আঘাত দিয়ে আগাম বার্তা দিয়ে যাচ্ছে তারা। এহেন পরিস্থিতে কিছু হাক্কানী আলেম- ওলামারা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করলেও এক শ্রেণীর স্বার্থবাদী আলেম গা ঢাকা দিয়ে কিংবা উল্টো ফতোয়া দিয়ে নিজেদের ফায়দা হাসিল করছে সবসময়। যেমনি ভাবে বাদশাহ আকবরের প্রতিষ্ঠিত দ্বীন-ই-এলাহী স্বপক্ষে করেছিল মাওলানা জালাল উদ্দিন নামের কথিত আলেম। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে বাগদাদের মতই হবে বাংলাদেশের ইসলাম ও মুসলমানদের করুন অবস্থা। স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি ও করডোবার মতই এদেশ থেকে নিঃশেষ হবে মুসলমান ও অকাতরে বিলীন হবে ইসলাম এবং থমকে যাবে সত্যের জয়রথ।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, মিরপুর দাখিল মাদ্রাসা, হবিগঞ্জ।