করাঙ্গী নিউজ
স্বাগতম করাঙ্গী নিউজ নিউজপোর্টালে। ১৫ বছর ধরে সফলতার সাথে নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করে আসছে করাঙ্গী নিউজ। দেশ বিদেশের সব খবর পেতে সাথে থাকুন আমাদের। বিজ্ঞাপন দেয়ার জন‌্য যোগাযোগ করুন ০১৮৫৫৫০৭২৩৪ নাম্বারে।

আমিনুর রশীদ এমরান: একটি নক্ষত্রের পতন

  • সংবাদ প্রকাশের সময়: শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০
কামাল এম মোস্তফা: কি লিখব ? এমনিতেই করোনার দ্বিতীয় পর্বের তান্ডবে মিশিগান অঙ্গরাজ্যের অনেক বাঙালি আক্রান্ত । বয়স্ক মানুষরা একে একে না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে । প্রতি সপ্তাহে স্থানীয় মসজিদে দু তিন টি জানাজার নামাজ হচ্ছে । এই প্রিয় মানুষ গুলো কে গত দুই যুগ কাছে থেকে দেখেছি । আজ তাঁরা চীর দিনের জন্য বিদায় নিচ্ছেন । সঙ্গত কারণেই মন মানসিকতা ভালো নেই । তার উপর বিভিন্ন ধরনের অসুখ বিসুখ ও মানসিক চাপে জীবন বিপর্যস্ত । কখন নিজে র ও চলে যাই , একমাত্র আল্লাহ ই জানেন । ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু স্বাভাবিকভাবে করতে পারছিনা ।

মৃত্যু অবধারিত সত্য । যে কোন ধর্ম বর্ণ গোষ্ঠীর জন্য তা নির্ধারিত । মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের পূর্ণতা পায়

ও পরিসমাপ্তি ঘটে । সাধারণত পরিপূর্ণ বয়সে মৃত্যুবরণ হলে সেটা মেনে নেয়া যায় । কিন্তু অকালে চলে যাওয়া , অসময়ে চলে যাওয়া যে কতো কষ্টের । তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউই বুঝতে পারে না । যার যায় সেই বুঝে কি অসহনীয় যন্ত্রণা । যার শুরু আছে শেষ নেই । করোনা মহামারী কালে আমরা দেশে বিদেশে এমন অনেক মানুষকে হারিয়েছি । মনকে শান্তনা দিয়েছি তাঁর আয়ু শেষ বলে । নিঃসন্দেহে আল্লাহর হুকুমে তার মৃত্যু হয়েছে । যদি একি এলাকায় প্রতি সপ্তাহে চার পাঁচজন মৃত্যু বরণ করে তখন যেন কেমন লাগে ?

তেমনি একটি মৃত্যু আমিনুর রশীদ এমরান । আমার লেখার পাঠকদের তথা হবিগঞ্জ জেলা বাসিকে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো কিছু নেই । জাতীয়তাবাদী ঘরানার মানুষসহ সকল দলের মানুষ তাকে এমরান এ নামেই ডাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে । হবিগঞ্জ জেলায় বিএনপি ও ছাত্রদলের রাজনীতিতে সে অনেক পদ ই অলঙ্কৃত করেছে । পদের কথা লিখে আমার লেখার কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না । সে একাধারে ছিল রাজনৈতিক নেতা ও ক্রীড়া মোদী । রাজনৈতিক ময়দানের পাশাপাশি খেলাধুলার জগতে ও ছিল তার ঈর্ষণীয় পদচারণা । যদি ও তার সাথে আমার রাজনৈতিক ও খেলাধুলার জগতে কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না । কিন্তু তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তার এসব কর্ম কান্ড আমার চোখ এড়াতো না । উপরন্তু একি জেলার বাসিন্দা হওয়ায় তার ব্যাপারে অনেক খবরাখবর জানতে পারতাম ।

বিশেষ করে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বর্তমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে তার নির্ভীক ও সাহসি ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত । আমি ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে দেশান্তরী হই । তখনকার যোগাযোগ ব্যাবস্থা এখনকার মতো সহজ লভ্য ছিল না । পত্র পত্রিকাও অনলাইনে ছিলনা । ছিলনা কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম । তাই অনেক খবরাখবর থেকে যায় আমার অগোচরে । এরশাদ পতনের পর জাতীয়তাবাদী দল দু টার্ম ক্ষমতায় ছিল । ১৯৯১ ও ২০০৪ সালে । মাঝে ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকে । বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তার নেতা কর্মীরা ও উদর পূর্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকে ।

কিসের নিয়ম , কিসের অনিয়ম দলের নাম ভাঙিয়ে অনেকেই তখন আঙ্গুল ফুলে বটগাছ । চোখের সামনে দেখতে পেলাম আমাদের সমবয়সি কথিত নেতারা বড় ভাই ডেকে ডেকে অতি সঙোপনে আখের গুছিয়ে নিয়েছে । জেলা শহরে অনেকেই বাসা বাড়ি করে ফেলেছে । বড় ভাই মন্ত্রীদের তৈল মেরে , মেকি আত্বীয়তার ফাঁদ পেতে ঢাকায় ফ্লাট বাড়ি গাড়ি করে ফেলেছে । রাগ করবেন না এই চিত্র শুধু হবিগঞ্জের নয় । প্রতিটি জেলার বড় ভাইয়েরা যার যার এলাকার মন্ত্রীদের দিয়ে এমন কাজ করিয়েছে । মন্ত্রীদের ও না করে উপায় নেই । এলাকায় বড় ভাই মন্ত্রীর রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দু । তাকে ছাড়া মন্ত্রী সাহেব এলাকায় অচল । এটি হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবহমান কালের ঐতিহ্য । যাকে আমরা চেইন অব কমান্ড বলি ।

যার ধারাবাহিকতার বাহিরে বর্তমান সরকার ও যেতে পারছেনা । স্বাধীনতা পরবর্তী কালে যত দল ই ক্ষমতায় এসেছে কেউই এ বৃত্তের বাইরে যেতে পারেনি । জনকল্যাণে সরকার নিয়োজিত না থেকে থেকেছে শুধু দলের নেতাকর্মীদের কল্যানে । যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সে আকাঙ্ক্ষা আজো অধরা । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শুধু নামে আছে । কার্যত জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কোন সরকারের আমলেই পুরোপুরি ঘটেনি । ( যে মাত্রায় ও গতিতে দলের নেতাকর্মী ও চামচা লাভবান হয় , সে মাত্রায় জনগণ হয়না ) যা হচ্ছে তাঁর সুফল দল নির্ভর । দলের নেতাকর্মীদের ভাগ্য বদল হয় । সাধারণ মানুষের হয় না । দলীয় নেতা নেত্রীর ভাগ্য সদা সর্বদা সুপ্রসন্ন ।

যে কারণে দিনে দিনে সাধারণ মানুষ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে । তাদের মুখে এক কথা , “ লঙ্কা যে যায় সেই রাক্ষস “। ক্ষমতার পালাবদলে আমাদের কিছু যায় আসে না । আজ এ সরকার তো কাল আরেক সরকারের নেতাকর্মীরা খাবে । যে কারণে সরকার পরিবর্তনে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমে গেছে । একমাত্র রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ছাড়া কেউ পরিবর্তনের ঝুঁকি নিতে চায় না । তাই বাংলাদেশের রাজনীতি না করা বিশাল জনগোষ্ঠী দিনে দিনে ভোটের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে । অবশ্য এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের মেকানিজম নিয়ে ও অনেক অভিযোগ রয়েছে । এ নিয়ে একটি গবেষণা হওয়া দরকার । স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ চিত্র ভিন্ন । অসৎ প্রার্থীরা সামান্য নগদ নারায়নের মাধ্যমে গরিব মানুষদের ভোটে নিয়ে আসে ।

অনেকে আবার তার আত্মীয়তার খাতিরে , গোষ্ঠীর টানে অথবা আঞ্চলিকতার কারনে ভোট প্রদান করে । এমরান এর কথা লিখতে গিয়ে সঙ্গত কারণেই এ লেখা চলে এলো । এমরান যে পর্যায়ের নেতা ছিল যদি তার সরকারের দু টার্ম মন্ত্রীদের জন্য খাটি সরিষার তৈল নিয়ে ঢাকা দৌড়াদৌড়ি করত তাহলে সে অনায়াসে বাকি জীবন সুন্দর ভাবে কাটিয়ে দিতে পারতো । কিন্তু সে তা করেনি । আমেরিকায় এসেও কঠিন পরিশ্রম করে বৈধ উপার্জন করেছে ।

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যু হীন প্রান
মরনে তাই তুমি করে গেলে দান ।
আমি আগেই বলেছি তার সাথে আমার তেমন পরিচয় বা ঘনিষ্ঠ তা ছিল না । এমরান আমেরিকায় এসেছে যখন জানলাম তখন সে নিউইয়র্কে বসবাস করতো । এবং রাজনীতির জন্য প্রায় ই দেশে আসা যাওয়া করতো । কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়ে অনেক কড়াকড়ি আরোপ করে । তাকে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বলে গ্রীন কার্ড রাখতে হলে আমেরিকায় থাকতে হবে । নতুবা বাংলাদেশ একে বারে চলে যাও । তখন ই মুলত এমরান থেকে যায় । তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আটকে যায় । তার উপর দুটো মাসুম ফুটফুটে বাচ্চার মায়া ও তাকে আটকে রাখাতে সাহায্য করে । ইতোপূর্বে বার বার কারান্তরীণ থাকার পরও সে দেশের জন্য ছিল উদগ্রীব । তার তৃষিত আত্মার আকুতি ফেসবুকে এখনও জ্বল জ্বল করছে । তার লেখার হাত ও ছিল অনেক শক্তিশালী । ভাষা প্রয়োগে তার অগাধ জ্ঞান ছিল । বক্তব্য প্রদানে সে ছিল ঈর্ষণীয় মেধাবী । বিভিন্ন কারণে ই হবিগঞ্জের স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক অঙ্গনে সে ছিল এক ধ্রুবতারা ।
মিশিগান থেকে প্রকাশিত ও চিন্ময় আচার্যি দেবু সম্পাদিত সুপ্রভাত মিশিগান লিখেছে হবিগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক আলোচিত নাম আমিনুর রশীদ এমরান । তুখোড় এক ছাত্র নেতার নাম এমরান । স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলেন জনপ্রিয় নেতা । যার বক্তব্যে উত্তপ্ত হয়ে ওঠতো হবিগঞ্জ জেলার রাজনৈতিক মাঠ । তিনি ছিলেন সজ্জন ব্যক্তি , সদা হাস্যোজ্জ্বল।
নিউইয়র্ক থেকে মিশিগান আসার পর তার সাথে আমার পরিচয় হয় ব্যাকিগত পর্যায়ে । তার পর আন্তরিকতা বাড়তে থাকে । তার আচার আচরণ কথা বলার ধরনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যেতাম । জেলা শহরে বড়ো হওয়া
সারাজীবন রাজনীতি করা মানুষ এতো সহজ ও সরল । চেনা রাজনীতি বিদদের চেয়ে সে ভিন্ন । রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রে একটু ভিন্নতা থাকে । ভিতরে এক বাহিরে এক । নাহলে নাকি রাজনীতি করা যায়না । কিন্তু এমরানকে দেখেছি ভিতরে বাহিরে এক । তার কোন অহঙ্কার নেই । কর্মব্যস্ত থাকার কারণে তার সাথে তেমন দেখা সাক্ষাৎ হতো না । কিন্তু যখন ই দোকান পাটে দেখা হতো সে খুব দরদ মাখা কন্ঠে বলতো “ কামাল ভাই আপনার কোন চিন্তা নাই , আপনার শেষ আমাদের শুরু।
আমার বার বার মনে পড়ে তার কথা গুলো । আর চোখ দিয়ে ছল ছল করে পানি পড়ে বয়সে সে আমার দু একবছরের ছোটো হবে । কিন্তু আমার আগেই চলে গেছে । অথচ সে হবিগঞ্জ বাসিকে অনেক কিছু দিতে পারতো । তার ভীতরে ছিল এক অমিত সম্ভাবনার বীজ । মিশিগান মুভ করার পর এমরান অনেক টা লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যায় , নিজেকে গুটিয়ে নেয় । যার শরীরে মনে সদা সর্বদা রাজনীতির চিন্তা ভাবনায় ছটফট করার কথা , সেই মানুষটি হঠাৎ নিরব হয়ে যায় । তার এ নিরবতা ছিল অভিমানের , স্বেচ্ছা নির্বাসনের ।
হবিগঞ্জের বহুল প্রচলিত দৈনিক খোয়াই পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক রোটারিয়ান শামীম আহসান বলেন আমিনুর রশীদ এমরান আপাদমস্তক একজন ভদ্র মানুষ । যার আচার আচরন ছিল খুবই শিষ্টাচার সম্মত । তার হাসি মাখা মুখের ছবি আমার চোখে গেঁথে আছে ‘’ । আমি জানি না তার অকাল মৃত্যুতে হবিগঞ্জ বাসির প্রতিক্রিয়া । কিন্তু মিশিগানে বসবাসরত দল মত নির্বিশেষে বাংলাদেশীরা গভীর ভাবে শোকাহত । তার মৃত্যুতে অনেকেই অঝোর ধারায় কেঁদেছে । বিজয় দিবস উপলক্ষে হবিগঞ্জ বাসির এক ভার্চুয়াল আলোচনায় সভাপতির সদয় আমন্ত্রণে আমার থাকার সৌভাগ্য হয় । সেখানে ও দেখেছি অনেক প্রতিভাবান শিক্ষাবিদ , প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতারা তাঁর অকাল মৃত্যুতে শোক প্রকাশ ও দোয়া করেছেন । আমি পরম শ্রদ্ধেয় উনাদের নাম উল্লেখ করতে পারছিনা রাজনৈতিক ভিন্ন মতের কারণে যদি উনারা বিব্রত বোধ করেন । কারন আমাদের রাজনীতিতে ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীল ও সহানুভূতি এখন আর নেই ।
কবির ভাষায় বলতে হয়
এমন জীবন করিবে গঠন
মরিলে হাসিবে তুমি
কাঁদিবে ভূবন ।

 

লেখক: মিশিগান যুক্তরাষ্ট্র ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো সংবাদ