সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ০২:১৪ অপরাহ্ন
মোঃ মনিরুজ্জামান: তুখোড় মেধাবী ছাত্র নীরব। হেডস্যার শিক্ষক মিলনায়তনে শিক্ষকদেরকে নীরবের প্রতি আলাদা দৃষ্টি দিয়ে পড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন। বিশেষ করে অংক, ইংরেজি ও বিজ্ঞানের শিক্ষকদের প্রতি তিনি এই বিশেষ অনুরোধ করলেন। নীরব প্রতিটি পরীক্ষায় তার মেধার দ্যুতি ছড়িয়ে সকল বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হতে লাগলো। স্কুলের শিক্ষকগণ ও ছাত্র/ছাত্রীর কাছে নীরব দ্রুতই প্রিয়ভাজন হয়ে উঠলো। সে সময়ে স্কুলে কোনো শিক্ষয়িত্রী ছিলো না।
নীরব ৬ষ্ট শ্রেণি থেকে গণিতে পূর্ণ ১০০ নম্বর এবং অন্যান্য বিষয়ে ৯০ এর উপরে নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে ৭ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। তার এই সফলতার পিছনে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকদের অবদান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও পরিবার থেকে নীরবের সেজো ভাই সরণের ভূমিকা ভিন্ন মাত্রায় অবদান রেখেছিল। তিনি সকাল-সন্ধ্যায় নীরবকে নিয়মিত পড়াতেন, লেখাতেন এবং প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ যথাযথভাবে বুঝিয়ে দিতেন। তার ভূমিকা শুধু লেখা-পড়া শেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, তিনি নীরবকে শাসন-বারণ, জীবন দর্শন ইত্যাদি জীবন-সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়েই গাইড করতেন। সেজো ভাই তার ভূমিকার কারণেই ছিলেন নীরবের জীবনাদর্শ।
টানা-পোড়েনের সংসারে নুন আনতে পান্তা শেষ হয়, শেষে নুন ছাড়াই পান্তা খেতে হয়। সে পান্তা যে কত স্বাদের তা যারা খাইনি তারা তা আঁচও করতে পারবে না। নুন ছাড়াই পান্তা খাবার খেয়ে নীরবদের পরিবারের সদস্যরা নীরবের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে থাকে। তাদের সকলেরই আশা- নীরব একদিন অনেক বড় হবে, তখন সংসারের দুঃখ ঘুচবে, আজকের এই কষ্টের কথা তখন আর মনে থাকবে না।
নীরবের সেজো ভাই কলেজে দু’বছর যেতে না যেতেই বিমান বাহিনীতে চাকরি পান। তিনি চাকরিতে যোগদান করেন। সেজো ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে নীরব এক গভীর সংকটে পড়ে, সংকটে পড়ে তাদের পরিবার। নীরবের ছোট দুই বোন ময়না আর অহনাও বেশ মেধাবী। নীরবের মেধাই তাদের এ অনুপ্রেরণার পিছনে অনেকটা ভূমিকা রেখেছে। নীরবের ছোট দুই ভাই মাঝারি ধরনের মেধাবী। সেজো ভাই-ই এদের সকলের পড়াশুনার দেখভাল করতো। মাঠে সামান্য পৈত্রিক জমিতে চাষাবাদ হতো, মেজো ভাই রহম চাষাবাদ করতো ও মাঠ দেখাশোনা করতো। তাকেও পরামর্শও দিয়ে সহযোগিতা করতো সেজো ভাই সরন।
সেজো ভাইয়ের অনুপস্থিতিজনিত সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সংগত কারণে নীরবকেও ভূমিকা রাখতে হলো। সে ছাড়া এমন কেউ নেইও যে এ ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও মেজো ভাই রহম ছিলো কিন্তু তার অক্ষরজ্ঞান না থাকায় লেখাপড়া সংক্রান্ত ব্যাপারে তার ভূমিকা রাখা সম্ভব ছিল না। বড় ভাই আরব অভাবের সংসারের অভাব ঘোঁচতে টাকা রোজগারের প্রত্যাশা নিয়ে একদিন ঢাকায় যাচ্ছে বলে সেই যে ঢাকায় গিয়েছে আর ফিরে আসেনি। সেটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের পরের বছরের ঘটনা। বছর দুই পরে নীরবদের গ্রামের আনিসুল ঢাকা থেকে গ্রামে এসে নীরবের মাকে গোপনে বলেছিল, ‘আরব ভাইকে ঢাকায় বাসের হেলপারের কাজ করতে দেখেছি।’
নীরবের মা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে,”যে সংসারের বড় ছেলে বট গাছ হতে পারে না, সে সংসারের পতন আসে তাড়াতাড়ি।”
সংসার চালাতে সাহায্য করা এবং ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়ায় সাহায্য করতে গিয়ে নীরব তার লেখাপড়ার গতিতে সমত্বরণ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। যদিও নীরব লেখাপড়ায় অসম্ভব মেধাবী। ঐ বয়সেই তার মধ্যে প্রতিভার আলোকছটা দেখা যাচ্ছিল। তার গ্রাম, আশেপাশের গ্রামের অনেক কিশোরী, তার ক্লাসের একাধিক ছাত্রী নীরবের সাথে একটু আগবাড়িয়ে কথা বলতে মুখিয়ে থাকে। বয়সের স্বাভাবিক লজ্জা, অজানা শিহরণ, আশঙ্কামিশ্রিত দুষ্টুমি নীরবের মাথায় ঘুরপাক খায়। সেজো ভাই না থাকাতে শাসন-নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ায় নিজের মধ্যে একটা স্বাধীন স্বাধীন ভাব জেগে উঠতে থাকে।
জীবনের লক্ষ্য স্থির করা এবং মেধার সাথে অধ্যবসায়ের সমন্বয় সাধন করতে না পারলে, জীবন মাঝিবিহীন নৌকার পরিণতি পায়। নীরবকেও এ সত্য গ্রাস করতে থাকে। বার্ষিক পরীক্ষায় আগের থেকে অপেক্ষাকৃত কম নম্বর পেয়ে সে দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী বিকাশের থেকে মাত্র ১৮ নম্বর বেশি পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে ৮ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়।
চলবে…
লেখক: পুলিশ পরিদর্শক, পিবিআই,নরসিংদী জেলা।