সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ০২:০০ অপরাহ্ন
এম এ মজিদ: প্রায় ২০ বছর আগে হঠাৎ করে যখন চ্যানেল আই টিভিতে মতিউর রহমান চৌধুরীর উপস্থাপনায় রাত ১২টা ১ মিনিটে “ গ্রামীণ ফোন আজকের সংবাদপত্র” প্রচারিত হয়, তখন বিষয়টি খুব মানানসই মনে হয়নি। মনে হতো রাত ১২টায় কে জেগে জেগে এসব শুনবে। অল্পদিনের ব্যবধানে ধারনাটি ভুল প্রমানিত হল। পরদিন রাজনীতি সচেতন মানুষগুলোর মুখে মুখে আগের দিনের টক-শো’র বিষয়বস্তু। পড়ন্ত বয়সে বাংলাদেশের আইডলে পরিনত হন মতিউর রহমান চৌধুরী।
সাবলিল উপস্থাপনা, ভাবভঙ্গি, স্বল্প কথা বলে আমিন্ত্রত অতিথিকে দীর্ঘ আলোচনা করার সুযোগ করে দেয়ার মতো বিশেষ যোগ্যতা মতিউর রহমান চৌধুরীকে অনেক উচ্চ আসনে নিয়ে যায়। এরই সাথে গ্রামীণ ফোন আজকের সংবাদ পত্র অনুষ্ঠানের দর্শক প্রিয়তার শীর্ষে চলে আসে। এই একটি অনুষ্ঠানের কারণে অন্যান্য টিভি চ্যানেলগুলো দর্শক হারাতে শুরু করে।
পর্যায়ক্রমে বর্তমানে বিটিভিসহ বেসরকারী সব টিভি চ্যানেলই রাত ১২টা ১ মিনিটে ভিন্ন ভিন্ন নামে টক-শো চালু করে। আমার মনে হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের মানুষ যেখানে ডিশ সংযোগ নেই সেখানকার মানুষ ছাড়া অধিকাংশ মানুষ শুধু রাত জেগে থাকে টিভিগুলোর টক-শো শুনার জন্য। একটা জাতীর বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যরাতের ঘুমকে কিভাবে কেড়ে নিতে হয় তা দেখিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো।
সেই অর্থে বাংলাদেশের নারীদের ঘুম কেড়ে নিতে পারেনি বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো। তবে বাংলাদেশের নারীদের খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় কেড়ে নিচ্ছে ভারতীয় চ্যানেলগুলো। রাত ৮টা, ৯টার দিকে যখন মায়েদের রাতের খাবার তৈরীর সময় বা বাচ্ছাদের পড়ানোর সময় ঠিক এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভারতের স্টার জলসাসহ বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার করা হয় নাম না জানা অনেক সিরিয়াল।
সিরিয়াল দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন নারীরা। পরের দিনে বাংলাদেশী নারীদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে যায় ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত বউ শাশুরি যুদ্ধের কাহিনী, পরকিয়া প্রেমের মতো ঘৃণিত ঘটনা আর নায়িকা ও নায়িকার মা-দের পরনের শাড়ির গুনগান।
আত্বীয় স্বজনদের মাঝে অনেককে দেখেছি শুধু ভারতীয় চ্যানেল দেখতে গিয়ে একাধিকবার চুলায় বসানো ভাত-তরকারী পুড়ে গিয়ে পাতিল পর্যন্তও পুড়ে যেতে, টিভি সিরিয়াল দেখার জন্য ছেলে মেয়েদের পড়ার সময় সূচি পরিবর্তন করে দিতে, হাউজ টিউটরকে সিরিয়াল প্রচারের সময় না আসার অনুরোধ করতে। মিডিয়াগুলো আসলেই সাধারণ মানুষের আবেগ অনুভূতিকে পূজি করে লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করে দিতে পারে।
বাংলাদেশে হয়তো ২০ বছর আগে টক-শো শুরু হয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে টক-শোর বয়স অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেছে। সাংবাদিক অপেরা উইনফ্রে’র নাম হয়তো অনেকে শুনেছেন। বিশ্বের নাম্বার ওয়ান উপস্থাপিকা হিসাবে তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেক আগেই।
১ ঘন্টার একটা লাইভ অনুষ্ঠান উপস্থাপনার জন্য উইনফ্রেকে দিতে হয় বাংলাদেশী টাকায় ৩ লক্ষাধিক টাকা। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার মোহাম্মার গাদ্দামী, ইসরাইলের জেক শিরাক, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাতের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে তিনি নিজেই একটি টিভি চ্যানেল খুলেছেন।
১ ঘন্টার একটি লাইভ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে গিয়ে উইনফ্রে নিজে কথা বলেন মাত্র ৫ থেকে ৭ মিনিট। বাকী ৫৩ থেকে ৫৫ মিনিট সময়ই আমন্ত্রিত অতিথিকে দিয়ে উইনফ্রে কথা বলান। অল্প কথায় সুন্দর সুন্দর সাবজেক্ট তুলে দিয়ে আমন্ত্রিত অতিথিকে কথার ফুলঝুড়িতে ব্যস্ত রাখার মতো অসাধারণ গুন রয়েছে উইনফ্রের মাঝে। এর বিপরীতে বাংলাদেশী বেশির ভাগ উপস্থাপক অনেক বেশি কথা বলেন, আমন্ত্রিত অতিথিদের মুখের কথা কেড়ে নেন, নিজেই মতামত দিয়ে দেন, অথবা নিজের মতো করে মতামত আদায় করতে বাধ্য করেন। বিষয়টা খুবই বিরক্তিকর, অসাংবাদিকমূলক, অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
লন্ডন আমেরিকায় টক-শোগুলোতে প্রতিদ্বন্ধি রাজনৈতিক নেতাদের হাজির করা হয়। প্রায় সময়ই লাইভ অনুষ্ঠানে অতিথিদের মাঝে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। জুতা ছুড়াছুড়ির ঘটনাও ঘটে। জর্ডানের টিভিতে প্রচারিত টক-শোর ছবি হাস্যকর। দুই প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থীকে টক-শোতে হাজির করা হল। কিছুক্ষন একে অপরের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক, তারপর হাতাহাতি। এক পর্যায়ে একজন অতিথি রাগান্বিত হয়ে নিজের কোমড় থেকে পিস্তল বের করে অন্যজনকে গুলি করার চেষ্টা করলেন। বাংলাদেশের টক-শো’র সর্বোচ্চ বাকবিতন্ডা হয়েছে আরটিভিতে। সাবেক নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান মারার জন্য তেড়ে আসছিলেন সাবেক মন্ত্রী ব্যারিষ্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াকে।
বিরোধীদলের কাছে টক-শো যতটা জনপ্রিয়। সরকারীদলের কাছে ঠিক ততটাই অজনপ্রিয়। কারণ বিবেকের তাড়নায় টক-শোতে আসা বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক সময় সত্যটাই বলে ফেলেন। বিএনপি সরকারের আমলেও টক-শো সরকারের কাছে বিশ্বাদ মনে হতো। সেনা শাসিত তত্বাবধায়ক সরকারের আতংকের সময় ছিল রাত ১২ টা ১ মিনিট। তারা টক-শো বন্ধের জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু সম্ভব হয়নি। আসলে টক শো বা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ নয়, তাদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া উচিৎ। যদি টক শোতে বা মিডিয়ায় কোনো মিথ্যা বলা হয় এবং সত্য গোপন করা হয়, তাহলে জনগনই এসব প্রত্যাখ্যান করে ফেলবে।
লেখক: আইনজীবী ও সাংবাদিক।