রবিবার, ১১ মে ২০২৫, ০৩:১৭ পূর্বাহ্ন
এড. মইনুল হাসান দুলাল :
বৈশ্বিক মহামারীতে কর্মহীন ও গৃহবন্দী মানুষের চরম খাদ্যাভাব সাধারণ মানুষকে আতংকিত করে তোলেছে। এগিয়ে আসছে সরকার, সাধ্যনুযায়ী দেশের বিত্তবান, প্রবাসী, সামাজিক, রাজনৈতিক, পেশাজীবী সংগঠনগুলো সহায়তা করেই চলেছেন। সৎ সাহসী জনপ্রতিনিধিরা যেখানে জীবনের ঝুকি নিয়ে রাত-বিরাতে ছুটে চলেছেন কর্মহীনদের দ্বারে দ্বারে সেখানে দেশের চরম দূর্দিনে কিছু অসৎ প্রকৃতির স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কারণে ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও আত্মসাতের খবরে দেশবাসী রীতিমতো বিস্মিত হচ্ছেন। কমিটি উপকমিটি তদারকি কমিটি এবং কয়েক ডজন জনপ্রতিনিধি বরখাস্থ করার পরও থামছে না চাল চুরি, তেল চুরির নিয়োমিত বুলেটিন।
সম্প্রতি সরকার এসব অনিয়ম রোধে ও তৃনমুলে কর্মহীনদের সরাসরি সহায়তা পৌছে দেবার লক্ষ্যে সারা দেশে ৫০ লক্ষ পরিবারে নগদ জনপ্রতি ২৫০০ টাকা সহয়তা দেবার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়। সাধারণ মানুষ নড়েচড়ে বসেন, এবার বুঝি সহায়তা নিজ হাতে পৌছাবে। কিন্ত পাল্টায়নি অসৎ চরিত্রের প্রতিনিধিদের চিরাচরিত আত্মসাৎ করার মানুষিকতা, শুধু পাল্টিয়েছে চুরির কায়দা মাত্র। ৮ লক্ষ নামের সাথে মোবাইল নাম্বারের গাফিলতি দেখে সাধারণ মানুষ বলছেন, সরকার কাফনের কাপড় বিতরণ করলেও কিছু সংখ্যাক লোক এগুলো দিয়ে পাঞ্জাবী বানাবে।
সরকার ঘোষিত নগদ সহায়তা স্ব-স্ব ইউনিয়ন থেকে তালিকা প্রাদানের দাবী জানালেও কে শুনছে কার কথা? জনগন যাবে কোথায়? এই পরিস্থিতিতেও কেনো তারা এমন করছেন? নিশ্চই ভোটের আগে মানুষ তাদের চরিত্রিক বৈশিষ্টগুলি বিবেচনা করেই ভোট দিয়েছিলো। ভাল মন্দ বিবেচনা করলে এমন হবে কেনো? না-কী এর অন্তরালে অন্য কিছ?
কিছু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনিয়ম ও আত্মসাতের ঘটনা নিয়ে আমি সমাজ সতেচন কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি। তাদের বক্তব্য হলো যারা আত্মসাৎ অনিয়ম করছেন তারা বিগত নির্বাচনে অনেক বেশী খরচ করেছেন এবং সুদে মুলে পোষিয়ে নিতেই তারা এমন করছেন, জনসেবা তাদের কাছে মুখ্য নয়। অনেকে বলছেন, ভোটের সময় ৫০০ টাকা দিয়ে ভোট বিক্রি করবেন আর ত্রান বিতরণে ফেরেশতা খুজবেন তা কী-ভাবে হয়? তাছাড়া আগামী বছর স্থানীয় নির্বাচনের শিডিউল রয়েছে। নির্বাচনী মাঠ জমাতে হলে তো বিরাট বাজেট চাই।
একজন প্রার্থী অন্য প্রার্থীর সমর্থককে ফোন করে বলেন, এবার নির্বাচনে ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করবো দেখি আমার সাথে কজন টিকতে পারে। তো উনি নির্বাচিত হলে বিভিন্ন খাত থেকে উনার ৫০ লক্ষ আদায় করবেন এটা স্বাভাবিক নয় কী? বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে অমুক ভাই তমুক ভাইকে নিজের পক্ষে মাঠে নামাতে পারলেই বুঝি নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে, সেজন্য চলে অন্তরালে নানাবিধ রফা-দফা। নিজেদের মাঠ গরম করতে নিজস্ব তহবিল থেকে এমন কী চড়া মুল্যে সুদ করে নির্বাচনের আগেই জনসেবার নামে ইট সলিং, মাটি ভরাট, কালভার্ট, টিউবওয়েল, গাইডওয়াল, ঘরের টিন, সিমেন্ট, বিভিন্ন প্রতিষ্টানে অনুদান এমনকী অনেক পরিবারের দেখভালও করতে দেখা যায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের।
শুধু কী তাই? নির্বাচনকালীন সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে অনেকেই কর্জ দেয়া-নেয়ার গোপন প্রদর্শনীতে শরীক হন। খেলার মৌসুম তো দুএকটা কভার করতে হবে তাই এ নিয়েও বেশ বড় বাজেট চাই। জার্সি বিতরনে প্রার্থীদের মধ্যে চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। স্থানীয়ভাবে অনেক ভালো ক্লাব সংগঠন থাকলেও নির্বাচনের কিছুদিন পুর্বে পাড়ায় মহল্লায় গড়ে উঠে নতুন নতুন সংগঠন । নির্বাচন যতো এগিয়ে আসে ততোই জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে প্রত্যাহ খরচের তালিকা। সর্বশেষ কোন কোন প্রার্থীরা সাধারণ মানুষের সরলতা ও দারিদ্রতার সুযোগে নগদ অর্থের বিনিময়ে তাদের চিন্তাচেনতার পরিবর্তন করারও প্রয়াস চলাতে দেখা যায় নির্বাচনের আগের রাতে। “৫০ লক্ষ যাক ভাই -তবুও আমার সোনার হরিণ চাই”।
সমাজ সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে অনেকে জনপ্রতিনিধি হতে চান। আবার অনেকেই আছেন জনপ্রতিনিধি হয়ে নিজের প্রভাব প্রতিপ্রত্তি ব্যবসা বানিজ্য ধন সম্পদ বাড়িয়ে নিজেকে ও পরিবারকে প্রতিষ্টিত করতে চান। সমাজের একটি ছোট অংশ রয়েছে নির্বাচন আসন্ন হলে তাদের প্রকৃত সরূপ প্রকাশ পায়। এরা প্রার্থীদের ধর্না ধরে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চায়, কুপ্ররামর্শ দিয়ে বাজেট বড় করতেই থাকে।
নির্বাচন করতে গিয়ে মাঠ নিজের আনুকুল্যে নিয়ে আসতে অনেক প্রার্থী সহায় সম্পদ বিক্রি করে এমনকি চড়া মূল্যে সুদে এনে নির্বাচনী বৈতরনী পার হতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে অসহায় হয়ে পড়েন, যা কাম্য নয়। আমাদের এই অপসংস্কৃতি বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় এর কুফল জনগনকে ভোগ করতে হবে যুগের পর যুগ। বাজেট যাই হোক আমায় পাশ করতে হবে এই মানুষিকতা পরিহার করতে হবে। সমাজে এখনো অনেক লোক রয়েছেন যারা শুধুমাত্র তাদের নিজ ও পারিবারিক যোগ্যতা বলে সততা কর্মদক্ষতা দিয়ে মানুষের মনে স্থান করে নিয়ে জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন সীমিত বাজেটের মাধ্যমে।
আমার নিজ ইউনিয়ন লস্করপুরে মজনু মিয়া চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েও তা তিনি ত্যাগ করেছিলেন। ফরিদ মিয়া বলতেন চোর বাটপারের ভোট আমার প্রয়োজন নেই কিন্ত উনি জনগন কর্তৃক ৫ বার নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং দুজনেই নিজেদের সহায় সম্পত্তি জনগনের তরে বিলিয়ে দিয়ে জনপ্রতিনিধির উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। কীর্তিমানের মৃত্যু নেই।
লেখক: আইনজীবী, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।
আইন ও প্রশিক্ষন সম্পাদক, জেলা সাংবাদিক ফোরাম হবিগঞ্জ।