করাঙ্গী নিউজ
স্বাগতম করাঙ্গী নিউজ নিউজপোর্টালে। ১৫ বছর ধরে সফলতার সাথে নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করে আসছে করাঙ্গী নিউজ। দেশ বিদেশের সব খবর পেতে সাথে থাকুন আমাদের। বিজ্ঞাপন দেয়ার জন‌্য যোগাযোগ করুন ০১৮৫৫৫০৭২৩৪ নাম্বারে।

বৈশ্বিক মহামারীতে আমাদের হবিগঞ্জ: সচেতন হব কবে?

  • সংবাদ প্রকাশের সময়: মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২০

এড. মইনুল হাসান দুলাল: মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে গজব? না-কি পৃথিবী নিয়ন্ত্রনে মানবসৃষ্ট কোন অপকৌশল? টক অব দ্যা ওয়াল্ড কোভিড ১৯। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই মানব জাতীর চারিত্রিক অধঃপতনের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে যোগে যোগে এরূপ মহামারী আবির্ভাব ঘটেছে, তেমনিভাবে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ বা ক্ষমতার মোহে পড়ে মানব সৃষ্ট অনেক জীবানু অস্ত্র অবিস্কারের কারণে লক্ষ কোটি মানুষ এর করাল থাবায় প্রাণ হারিয়েছেন।

মানব সৃষ্ট বা খোদায়ী গজব যাই হোক না কেন এর উৎপত্তি ও বিবর্তন নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতেই পারে। কিন্তু এই বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় পৃথিবীর শ্রেষ্ট বিজ্ঞানীরা একের পর এক সব চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মহামারী থেকে বাঁচতে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের উপরেই অনেক বেশী জোর দিচ্ছেন। নোভেল করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ চীন এখন সারা বিশ্বের কাছে এক রহস্যের চাদরে আচ্ছাদিত ।

করোনার প্রভাবে সারা পৃথিবী ব্যাপী দুই লাখ এগারো হাজার নয় শত তিপ্পান্ন (২১১৯৫৩) জন মানুষ মৃত্যু বরণ করছে কিন্ত চীন তাদের মৃতের সংখ্যা চার হাজার ছয়শ তে নিয়ন্ত্রন রেখে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কোভিড ১৯ এর জিরো থেকে খুজতে গেলে ২০১৯ সালের শেষের দিকে উহান নগরীর হুয়ানান সামুদ্রিক খাদ্যের পাইকারী বাজারে দোকানদারদের মধ্যে প্রথম ভাইরাসটি সংক্রমন ঘটে বলে ধারণা পাওয়া যায়। বাজারটিতে জীবন্ত বাদুর, সাপ ও অন্যান্য বন্য প্রানী ও তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিক্রি করা হতো। ১১ মার্চ করোনার পাদুর্ভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্প্রদায়ে সঞ্চালন বৃদ্ধি পেতে থাকলে ডব্লিউএইচও করোনাকে বৈশ্বিক মহামারী হিসাবে ঘোষনা করে।

 

উন্নত বিশ্বের দেশ বৃটেন, যুক্তরাষ্ট, ইতালি, স্পেনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো যেখানে মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন রেকর্ড অতিক্রম  করেছে সেখানে এর উৎপত্তি স্থল তথা চায়নিজরা সারা পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে তাদের লকডাউন শিথিল করে নিজেদের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে দেদারসে, যার কারণে চীনের প্রতি বিশ^বাসীর সন্ধেহ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

আমাদের দেশে করোনা আগমন ও বিস্থার রোধে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকাটা অযৌক্তিক নয়। উন্নত বিশ্বএই পরিস্থিতিতে বেসামাল ও অসহায়ত্ব
প্রকাশ করলেও আমাদের দেশে এরূপ মহামারীতে দ্বায়িত্বরত কর্তাব্যক্তিদের লাগামহীন আচরণ ও বক্তব্য দেশের সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণমানুষকে বারবার ব্যথিত করেছে। শুরুতে করোনা মোকাবেলায় সব প্রস্তুতি রয়েছে বললেও পরিস্থিতি যখন খারাপের দিকে যাচ্ছে তখন করোনার ফ্রন্ট যোদ্ধা ডাক্তার নার্সদের পিপিই সময়মতো সরবরাহ করতে ব্যর্থ এমনকি সরববাহকৃত এন ৯৫ মাস্ক গুলো নিয়েও  অভিযোগের অন্ত নেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। আগেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি রয়েছে বললেও সিলেটের ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়ে সময়ের প্রয়োজনে এয়ার এম্বুলেন্স,আইসোলেশন খুজেও পাননি।

দেশে করোনা যখন ধীরে ধীরে করাল  থাবা বসাতে শুরু করেছে ঠিক তখনই ইতালি ফেরত বিশাল বহরের বিমান যাত্রীদের শুধুমাত্র শিলমোহর দিয়ে তাদের ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইন এর প্রেসকিপশন হাতে ধরিয়ে দিয়ে সরকার তাদের দ্বায়িত্ব পালন করেছেন, সর্বনাশের শুরুটা কিন্ত এখান থেকেই। সরকারী হিসেব মতে, ২৮শে এপ্রিল পর্যন্ত ৬৪৬২ জন করোনায় আক্রান্ত যার মধ্যে ডাক্তার নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী প্রায় ১ হাজারেরও বেশি। দেশে প্রতিদিন গড়ে মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, যার ফলে প্রকৃত করোনা পজিটিভের সংখ্যা নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরাও সন্ধিহান রয়েছেন।

প্রবাসী অধ্যুষিত ও শিল্পাঞ্চল এলাকার সুবাদে চরম ঝুকিতে রয়েছে সিলেট বিভাগের প্রবেশদ্বার আমাদের হবিগঞ্জ। সময়োপয়োগী সিদ্ধানহীনতার কারণে এবং জনগনের সচেতনতার অভাবে হবিগঞ্জ আজ করোনার ডেঞ্জার জোনে পরিণত হয়েছে। হবিগঞ্জের শ্রমিকরা কাজের সুবাদে বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে ঢাকা নারায়নগঞ্জ গাজীপুর চট্টগ্রামে অবস্থান করে থাকেন। সরকার মহামারী মোকাবেলায় ২৬মে মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষনা, গনপরিবহন চলাচল সীমাবদ্ধতা, হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ দিলেও হবিগঞ্জ বাসী সচেতন না হয়ে করোনা নিয়ে নানা রূপ ঠাট্টা বিদ্রোপ করে একে উড়িয়ে দিয়ে পাড়ায় মহল্লায় আড্ডা, গল্প গোজবে লিপ্ত হতে থাকেন।

বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে প্রশাসন থেকে বারবার মাইকিং করেও এর কোন প্রতিকার করা সম্ভব হচ্ছেনা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চুপিসারে ও প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষ হবিগঞ্জে আসায় দিন দিন বেড়েই চলছে আক্রান্তদের তালিকা। তাছাড়া অফিস আদালত বন্ধ হলেও বন্ধ হয়নি হবিগঞ্জের শিল্প কারখানা।

এমতাবস্থায় গত ১১ এপ্রিল নারায়নগঞ্জ থেকে হবিগঞ্জে আসা মাইক্রোবাস চালক মোফাজ্জল হোসেনের নমুনায় প্রথম করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। এদিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় হবিগঞ্জের মাননীয় সাংসদ জনাব এড. আবু জাহির জেলা লকডাউন ঘোষনা করলেও জেলা প্রশাসন থেকে কয়েক ঘন্টা পরই তা অস্বীকার করা হলে হবিগঞ্জবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

২০ এপ্রিল লাখাই হেলথ কমপ্লেক্স এর একজন ডাক্তার ও একজন নার্সসহ মোট ১০ জনকরোনায় পজিটিভ শনাক্ত হন। ২১ এপ্রিল ১ জন নার্স ও নারায়ণগঞ্জ থেকে
আজমিরিগঞ্জে বাড়িতে আসা একজন নারী গার্মেন্টস শ্রমিক করোনা আক্রান্ত হন । ২২ এপ্রিল ৫ জন, ২৩ এপ্রিল স্বাস্থ্যকর্মীসহ ৩ জন, ২৪ এপ্রিল চিকিৎসকসহ ৫ জন, ২৫ এপ্রিল জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসক নার্স স্বাস্থ্যকর্মী ও ৩ ম্যাজিষ্ট্রেটসহ ২১ জন করোনায় শনাক্ত হন।

২৬ এপ্রিল বানিয়াচংয়ের একজন এসিল্যান্ড করোনায় আক্রান্ত হন। হবিগঞ্জে করোনায় আক্রান্ত ৪৮ জনের মধ্যে ২২ জনই সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য কর্মী। দীর্ঘদিন হবিগঞ্জে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা একজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও গত এক সপ্তাহে জ্যামিতিক হারে বেড়ে সেই সংখ্যাটি ৪৮ জনে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও ২৫ এপ্রিল চুনারুঘাটের ৫ বছরের এক শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্য বরণ করে। এসব আক্রান্ত রোগীর নমুনা সংগ্রহ ও চিকিৎসা করতে গিয়েই আক্রান্ত হয়েছেন একাধিক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীরা। এদিকে লাখাই ও চুনারুঘাট স্বাস্থ্য কমপ্রেক্স বন্ধ করা পর গত ২৫ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের ১২ জন আক্রান্ত হলে হবিগঞ্জের আকাশে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২৬শে এপ্রিল সিভিল সার্জনের অনুরোধে জেলা প্রশাসন আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের জরুরী সেবা বিকল্প রেখে ৩ দিনের জন্য লকডাউন ঘোষনা করেন। আক্রান্তদের অধিকাংশই হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন এবং অন্যান্যদের হবিগঞ্জ হাসপাতালের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে।

ঢাকা নারায়ণগঞ্জ গাজীপুর কিশোরগঞ্জ এর পরই
আক্রান্তের দিক দিয়ে হবিগঞ্জের অবস্থান। সিলেট বিভাগের ৪টি জেলায় করোনা রোগীদের মধ্যে হবিগঞ্জ শীর্ষে রয়েছে। জেলার আরো সাত শতাধিক সংগৃহিত
নমুনার রিপোর্ট এখনো না আসায় হবিগঞ্জবাসীর মধ্যে উৎকন্ঠা বিরাজ করছে। করোনা সংক্রামনের দিক থেকে আমাদের হবিগঞ্জের অবস্থান ধীরে ধীরে ক্রমশ খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিগত দিনে সত্যিকার অর্থে লকডাউন ঘোষনা করা হলে হয়তো আজ এমন পরিস্থিতিতে পরতে হতো না হবিগঞ্জবাসীকে। চীন ও দক্ষিন কোরিয়া করোনা প্রতিকার করেনি তারা প্রতিরোধ করেছে সঙ্গনিরোধের মাধ্যমে।

হবিগঞ্জ জেলায় করোনা মহামারী আকার ধারণ করার পূর্বেই চীন ও দক্ষিন কোরিয়ার ন্যায় গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ জনগনকে হোম কোয়ারেন্টাইন কঠোর ভাবে মেনে চলার অভ্যাস করতে পারলেই এর প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাই এখনো সময় আছে আমাদের সচেতন হতে হবে। বিনা  প্রয়েজনে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করতে হবে। পরিস্কার পরিছন্ন থাকতে হবে, বাহির থেকে এসে হেন্ড সেনিটাইজার ব্যবহার ও ভাল করে বারবার হাত পরিস্কার করতে হবে সর্বোপরি হোম কোয়ারেন্টাইন কঠোরভারে মেনে চলতে পারলে করোনা কে জয় করা অসম্ভব হবে না। আসুন সচেতন হয়ে নিজে সুস্থ থাকি অন্যকে সুস্থ রাখি।

লেখকঃ আইনজীবী, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো সংবাদ