শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ০৬:২৩ অপরাহ্ন
ফয়সল আহমদ রুহেল:
দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছিল। কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটেছেন। ছোট ভাই বোনদের পড়াশুনার খরচ যোগাতে হয়েছিল। খুব ছোট বেলায় হারিয়ে ছিলেন মাকে। পথচলা কতোটা কঠিন ছিল। এমতাবস্থায় পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া অকল্পনীয় ছিল। আর অসংখ্য-অগণিত বাধা ডিঙিয়ে সফলতায় পৌঁছানো মানুষটি হলেন মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি মাধবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।
জন্ম : মো. সিরাজুল ইসলাম হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. তালেব হোসেন, মাতা মোছা. মানিক চান্দ বিবি। বাবা ছিলেন কৃষক। ৭ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বড় ৪ ভাই ও ১ বোন চাকুরী থেকে অবসরপ্রাপ্ত। ছোট ৩ ভাই চাকুরীতে।
পারিবারিক : মো. সিরাজুল ইসলাম পারিবারিক জীবনে চার ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সিরাজুল ইসলামও ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে একটি বাসা ভাড়া করে ছেলে মেয়ে সকলকেই বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে পড়াশুনা করান। এই শিক্ষকের বর্তমানে কনিষ্ট ২ ছেলে ব্যতিত সকলেই ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে মো. মঈনুল ইসলাম, প্রিন্সিপাল অফিসার, সদন শাখা, রূপালী ব্যাংক, মতিঝিল, ঢাকা। ২য় ফায়েজা আক্তার, অনার্সসহ এমএ (১ম শ্রেণী) গৃহিনী। ৩য় খালেদা আক্তার, প্রিন্সিপাল অফিসার, পুরানা পল্টন শাখা, রূপালী ব্যাংক, পুরানা পল্টন, ঢাকা। ৪র্থ মো. সায়েদুল ইসলাম, এমএ ব্যবসা, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা। ৫ম মিসবাহুল ইসলাম, এমবিএম-বিআইবিএম (শিক্ষার্থী), চাকরী প্রার্থী ও ৬ষ্ঠ মো. আমিনুল ইসলাম, কোরআনে হাফেজ, অনার্স পাশ মাস্টার্সে (আরবী) অধ্যায়নরত।
শিক্ষাজীবন : মো. সিরাজুল ইসলাম এমবি স্কুলে (বর্তমানে গোবিন্দপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়) ১৯৫১ সালে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। ১৯৫৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন ওই বিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীতে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি ১৯৫৬ সালে হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার সাউথ কাশিমনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন ২য় বিভা উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৬৩ এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি (বিজ্ঞান) ৩য় বিভাগে পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিলেট সরকারী কলেজ থেকে বিএসসি ৩য় বিভাগে পাশ করেন। এছাড়া ১৯৭০-৭১ সালে তিনি বি.এড করার জন্য কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে ২য় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।
শিক্ষকতা জীবন : মো. সিরাজুল ইসলামের শিক্ষকতা জীবন শুরু হবিগঞ্জের সাউথ কাশিমনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে। তিনি ১৯৬৬ সালের ১ আগষ্ট বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ওই বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ বৎসর শিক্ষকতার পর ১৯৭০ সালের ৩০ জুন স্কুল হতে বিদায় নেন। এরপর তিনি মাধবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৭৩ সালের ৩ মে যোগদান করেন। ২০১০ সালের ১৫ জুলাই প্রায় ৩৭ বৎসর শিক্ষকতার পর ওই বিদ্যাপীঠ থেকে বিদায় নেন। সর্বমোট প্রায় ৪১ বছর শিক্ষকতার পর ৬৫ বৎসর বয়সে ২০১০ সালের ১৬ জুলাই অবসর গ্রহণ করেন।
এই শিক্ষক শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অত্যন্ত নিরলসভাবে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেছেন। যেন তারা প্রকৃত মানুষ হতে পারে। অত্যন্ত সততার সহিত বিদ্যালয়টির প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
মো. সিরাজুল ইসলাম যখন এইচএসসি পাশ করেন। তখন তাঁর ছোট চাচা এমসি কলেজে বিএসসি ২য় বর্ষের ছাত্র। চাচার পড়ালেখা চালাতে সিরাজুল ইসলামকে এক বৎসর পড়াশোনা বন্ধ রাখতে হয়। চাচার বিএসসি পাশের পর তিনি পুনরায় এমসি কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। শিক্ষকতা শুরুর পর সিরাজুল ইসলাম ছোট ভাই বোনদের পড়াশুনার খরচ যোগাতে সহায়তা করেন। বাবার এবং সেই সঙ্গে ছোট চাচার (শিক্ষক মৌলভীবাজার সরকারী হাইস্কুল) সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একে একে সব ভাইবোনদের প্রতিষ্ঠিত করেন। তাদের শিক্ষা সমাপ্তির পর নিজের ছেলেমেয়েদের শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। পাশাপাশি ছোট ভাইয়েরাও তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেন।
সিরাজুল ইসলামের কলেজ জীবনের তখনকার সময় যোগাযোগের এতো ভাল ব্যবস্থা ছিল না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রায় ৪ মাইল কাচা রাস্তায় হেঁটে হরষপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছাতেন। আটটায় ট্রেইনে চড়ে বিকাল পাঁটচায় সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছাতেন। সেখান থেকে কলেজ হোস্টেলে পৌঁছতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে যেত।
স্মরণীয় ঘটনা : সিরাজুল ইসলামের চাকুরী জীবনের স্মরণীয় ঘটনা বলতে মনে পরে ১৯৭৮ সনে বিদ্যালয় যখন পুরাতন অবস্থান থেকে নূতন অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়। তখন এলাকার কিছু প্রভাবশালী ও স্বার্থন্বেষী মানুষ বাজারের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত বিদ্যালয়ের জমিটি দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। এক ভোরবেলায় দেখেন বিদ্যালয়ে খালি জমিতে অনেকগুলো বাছাই তৈরি করে রীতিমত হাট বসেছে। ছাত্রদের সহায়তায় ঐ বাছাইগুলি ভেঙ্গে জমি পুনর্দখল নেন তিনি। তাদের দায়ের করা মিথ্যা মামলাগুলো মোকাবেলা করতে এই শিক্ষককে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ২ মাসের মধ্যে মনে হয় ৪০ দিনই হবিগঞ্জ কোর্টে যেতে হয়েছে। বর্তমানে ঐ জায়গায় কিছু ভবন নির্মাণ করে ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের বাসস্থান হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই রকম বহু ঘটনা এই শিক্ষককে মোকাবেলা করতে হয়েছে। ১৯৮১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় বিদ্যালয়ের ছাত্র অসিত কুমার পাল কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বাদশ স্থান অধিকার করে। মাধবপুর থানা শিক্ষক সমিতি তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। ঐদিন সিরাজুল ইসলামের চোখে পানি এসেছিল। এতো আনন্দ ছেলেমেয়েদের সাফল্যের দিনও তিনি পাননি।
সিরাজুল ইসলাম যখন ৭ম শ্রেণীর ছাত্র তাহার মা মারা যান। মৃত্যুশয্যায় শায়িত সিরাজুল ইসলামের মা শেষ রাতে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের কে দেখবে’। দ্বিতীয় মাও ঠিকই তাদের যথেষ্ট যত্ন করেছেন। তাঁর তত্ত্বাধায়নেই ভাই-বোন সবাই বড় হয়েছে। আজও সিরাজুল ইসলাম ভুলতে পারেননি মরহুম পিতাকে। দরিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি চেষ্টা করেছেন তার ছোট ভাইসহ সব ভাইবোন যেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হন।
সিরাজুল ইসলাম থানা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন একবার। কিন্তু শিক্ষকতা ভাল লাগত বলে এ মহান পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাননি। কৃষকের পরিবার থেকে আজ সিরাজুল ইসলাম। এ পর্যন্ত আসার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান বাবার। বাবার উৎসাহ, প্রেরণা না পেলে এ পর্যন্ত আসা সম্ভব হতো না। তাঁর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে ১ম শ্রেণীর পদে চাকুরী করছে।
গুনী এই শিক্ষক ২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্টিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশনের জরিপে মাধবপুর উপজেলার আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার পদকে ভুষিত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, ফাউন্ডেশন হবিগঞ্জ জেলার নয় উপজেলার ১৮ জন আদর্শ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে পদক দেয়ার পাশাপাশি তাদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)। পদকপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জন শিক্ষককে আর্থিক সহযোগিতাও দেবে সংস্থাটি।
আপনি আপনার সন্তানকে ভালোবাসলে সেও আপনাকে ভালোবাসতে শিখবে। আপনি তাকে গুরুত্ব দিলে সেও আপনাকে গুরুত্ব দেয়া শিখবে। আপনি আপনার বাবা-মাকে সম্মান করলে আপনার সন্তান তার বাবা মাকে সম্মান করা শিখবে। আপনি যদি আপনার স্ত্রী সন্তানকে আঁকড়ে ধরে রাখেন তাহলে তাঁরাও আপনাকে আঁকড়ে ধরে রাখবে। সিরাজুল ইসলাম পারিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক যে সুশিক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁর দেখানো ভালো মানুষত্বটাকে সন্তানরা আজ ধারণ করে এগিয়ে চলছে। এ মানুষটি সূর্যের মতো আলোকিত থেকে যাবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।গুণী এই শিক্ষকের প্রতি রইল গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা, আমরা তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।