রবিবার, ১১ মে ২০২৫, ১২:০৪ পূর্বাহ্ন
করাঙ্গীনিউজ:
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যাবের ভুয়া পরিচয়ে সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে সজ্জিত হয়ে চক্রের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশির নামে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। এছাড়া ডাকাতি, ছিনতাই ও অপহরণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তারা চালিয়ে যাচ্ছে। ৩০ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরের বছিলায় ডিবি পরিচয়ে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশির নামে ডাকাতির চেষ্টাকালে সংঘবদ্ধ চক্রের আট সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। এক বছরে চক্রের তিন শতাধিক সদস্যকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতারককে র্যাবও গ্রেফতার করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুধু ঢাকা ও এর আশপাশে ৩০টির মতো অপরাধীচক্র সক্রিয় রয়েছে। এর সদস্য সংখ্যা তিন শতাধিক। বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সামনে চক্রের সদস্যরা অস্ত্রসহ ওৎপেতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তারা টার্গেটে থাকা ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে গাড়িতে তুলে নেয়। এরপর মারধর করে টাকা ও মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। কখনো অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। অপরাধীদের পরনে কখনো ডিবি, আবার কখনো র্যাবের পোশাক থাকে। সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। গাড়িতে সাঁটানো থাকে বাহিনীর লোগো। চক্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যরাও থাকে। এ কারণে তারা আসল না নকল তা ভুক্তভোগীর পক্ষে বোঝা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়।
এ বছর ৩০ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরের বছিলায় ডিবি পরিচয়ে চেকপোস্ট বসিয়ে ডাকাতির চেষ্টাকালে সংঘবদ্ধ চক্রের আট সদস্যকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। তারা হলো-মোজাম্মেল হোসেন আপেল ওরফে হাজি, জাহাঙ্গীর, জমির খান, মজিবর রহমান মজিদ ওরফে মোক্তার, মাসুম গাজী, শফিকুল খরাদী, কুদ্দুস আলী ও কাউছার মিয়া। এ সময় তাদের কাছ থেকে অস্ত্র, ডিবি লেখা দুটি জ্যাকেট, ওয়াকিটকি এবং হ্যান্ডকাফ জব্দ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়-কয়েক মাস ধরে ঢাকা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় ডিবি পরিচয়ে তারা ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে।
গত বছর ২৯ আগস্ট দিনদুপুরে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার শহিদ বাকি রোডের ঢাকা ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা তুলে মোশাররফ হোসেন অপরাধীচক্রের কবলে পড়েন। ব্যাংক থেকে বেরিয়ে তিনি কিছুদূর যেতেই প্রাইভেট কারে আসা কয়েকজন ডিবি পরিচয়ে তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে গাড়ি থেকে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ৮ সেপ্টেম্বর গাবতলী এলাকা থেকে চার ভুয়া ডিবি সদস্য মামুন মন্ডল, আলী আহম্মেদ, সুমন শেখ ও আমির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ডিবির জ্যাকেট, ওয়াকিটকি, একটি পিস্তল, একটি খেলনা পিস্তল ও একটি প্রাইভেট কার জব্দ করা হয়।
২৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী লুৎফর রহমানকে ডিবি পরিচয়ে ৬-৭ জন জোর করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। তার চোখ বেঁধে মারধর করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। একটি বাসায় নিয়ে তাকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। মোবাইল ফোনে ভুক্তভোগীর ছেলেকে বলা হয়-‘তোমার বাবাকে আমরা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আটক করেছি। বর্তমানে তোমার বাবা আমাদের ঢাকার মিন্টু রোডের ডিবি অফিসে আছে। টাকা দিলে তোমার বাবাকে ছেড়ে দেব।’ পরিবারের পক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকা দিতে রাজি হওয়ার পর এক লাখ টাকা দেওয়ায় তাকে নির্যাতন করা হয়। এরপর তাকে নির্যাতন করে সেই ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাকে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। বিষয়টি জানার পর র্যাব ১ ডিসেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকা থেকে চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে। তারা হলো-রিপন সরদার, আহমেদুল কবির খান কাজল, মোসলেম উদ্দিন বাপ্পি, আসলাম ও রশিদ চাকলাদার। তাদের কাছ থেকে দুটি ডিবির জ্যাকেট, দুটি খেলনা পিস্তল, একটি হ্যান্ডকাফ, ১১টি মোবাইল ফোন, একটি প্রাইভেট কার ও নগদ ২৫ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।
শুধু তিনটি ঘটনা নয়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, এসব ঘটনায় অনেকে আইনের আশ্রয় নেন না। কেউ কেউ ভয়ে মুখও খুলতে চান না। ফলে বেশিরভাগ ঘটনা আড়ালে থেকে যায়।
ইতোপূর্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপরাধীচক্রের কাছে আসল রিভলবার-পিস্তল যেমন পাওয়া গেছে, তেমনি খেলনা আগ্নেয়াস্ত্রও মিলেছে। উদ্ধার হয়েছে ওয়াকিটকি, পোশাকসহ অপরাধে ব্যবহৃত ছুরি-চাকু ও অন্যের নামে নিবন্ধিত শত শত সিম।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানায়, তারা দুভাবে কাজ করে। একদল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সামনেসহ বিভিন্ন স্থানে কথিত অভিযানের নামে টার্গেটে থাকা ব্যক্তিকে গাড়িতে তোলে। এরপর মারধর করে অর্থকড়ি ছিনিয়ে নেয়। আরেক দল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সেজে নিয়োগ, বদলি, তদবিরের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযানে শটগান ব্যবহার করেন। আর অপরাধীরা কেবল ক্ষুদ্র্র আগ্নেয়াস্ত্র বহন করে। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, পুলিশের সরঞ্জামাদি খোলাবাজারে পাওয়া যায়। দুর্বৃত্তরা সেগুলো সংগ্রহ করে এবং দেখিয়ে প্রতারণা করে। খোলাবাজারে এসব বিক্রি সম্পূর্ণ নিষেধ। অথচ তা উপেক্ষা করে অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব বিক্রি করছে।
গোয়েন্দা পুলিশের আরেক কর্মকর্তা জানান, ভুয়া পুলিশ-র্যাবের চক্র গুঁড়িয়ে দিতে গোয়েন্দা তৎপরতার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান টহল আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অপরাধীদের তৎপরতা রোখার পাশাপাশি আসল-নকল যাচাইয়ের সুবিধার্থে ডিবি পুলিশের পোশাকেও ভিন্নতা আনা হচ্ছে। ডিবি পুলিশের জন্য এক ধরনের নতুন জ্যাকেট দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কাপড় খোলাবাজারে পাওয়া যাবে না। প্রতিটি জ্যাকেটে থাকবে কিউ কোড। এছাড়া ১ দশমিক ৫ ইঞ্চি লম্বা ডিবি লেখা রিফ্লেকটিভ টেপ অ্যাটাচমেন্ট এবং মিনি স্টেটমেন্ট পেচ পকেট (ওয়াকিটকি ব্যাটারি থাকবে)। এ জ্যাকেট তীব্র গরমেও পরতে অসুবিধা হবে না।
গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ রোববার বলেন, ডিবি পরিচয় দেওয়া অপরাধীদের রুখতে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। তিনি আরও বলেন, কেউ এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে এবং থানায় সহযোগিতা না পেলে ডিবিকে সরাসরি জানান। এ ধরনের অপরাধীচক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক আনম ইমরান খান রোববার বলেন, এ ধরনের অপরাধীরা মূলত র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অপরাধ সংঘটিত করে। বিভিন্ন অভিযানে র্যাব এ ধরনের প্রতারকচক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করছে। তিনি জানান, র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ২৬৭ জন প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে প্রতারকের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। তিনি আরও বলেন, আমরা যখন অভিযানে যাই, কালো ইউনিফর্ম পরে যাই। আমাদের প্রতিটি পিকআপের মধ্যে র্যাব ব্যাটালিয়নের নাম লেখা থাকে। এগুলো খেয়াল রাখতে হবে।
পুলিশের সাবেক আইজি একেএম শহীদুল হক শনিবার বলেন, সচেতনতাই হলো অপরাধীচক্রের কবল থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র উপায়। এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিলে তার আইডি কার্ড দেখতে হবে। সন্দেহ হলে প্রয়োজনে জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে সহযোগিতা চাইতে হবে।
সূত্র: যুগান্তর