শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ০৩:২৬ অপরাহ্ন
শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল: সরকার মিয়ানমার থেকে অত্যাচারিত হয়ে শরণার্থী রূপে আসা রোহিঙ্গাদের পূণর্বাসন করার জন্য নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য ২০১৭ সালে আশ্রয়ন প্রকল্প তিন নামে একটি আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরি করেন। ভাসানচরটিকে সরকার মিয়ানমার থেকে অত্যাচারিত হয়ে আসা শরণার্থী রোহিঙ্গাদের বসবাসের উপযোগী করার জন্য প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে।
ভাসানচরটিকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করার অভিপ্রায়ে সার্বিক অবকাঠামোর উন্নতি করা হয়। সেখানে বনায়নসহ যত রকমের সুব্যবস্থা মানুষের বসবাসের জন্য যা কিছু করা দরকার তার সবকিছুই সরকার করেছেন। কিন্তু যখন সরকার মিয়ানমার সেনাবাহিনী দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে আসা শরণার্থী রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্যোগী হয়, তখন দেখা যায় একটা কুচক্রী মহল সরকারের এই উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য বিভিন্ন রকমের অপচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। তারা অর্থাৎ এই কুচক্রী মহল মিয়ানমার থেকে অত্যাচারিত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে নানা রকম অপপ্রচার অপবাদ ছড়িয়ে একটি ধু¤্রজালের সৃষ্টি করে নিজেদের লাভের অংককে বাড়ানোর জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। একটি কুচক্রী মহল এমন ভাবে চক্রান্ত করতে থাকে যে, যাতে করে শরণার্থী রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে নিরুৎসাহিত হয়ে ওঠে।
অভিযোগ আছে এই কুচক্রী মহলের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দাতা সংস্থাসহ ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ী গ্রুপ। এছাড়া ক্যাম্পের নেতিবাচক মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিগণ এবং সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারাও জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আবার অনেকে বলে থাকেন কিংবা অভিযোগ করে থাকেন, শরণার্থী রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে না যেতে একশ্রেণীর এনজিওর লোকজনও পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে থাকেন।
পত্রপত্রিকার ভাষ্যমতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ যখন চাচ্ছিলেন মিয়ানমার সেনাবাহিনী দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পূনর্বাসন করে তাদেরকে শান্তিতে বসবাসের সুব্যবস্থা করা হউক, তখন দেখা যায় সরকারের সদিচ্ছা থেকে পরিচালিত রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পূনর্বাসনের কর্মকান্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এমন ভাবে বিতর্কিত কথাবার্তা ছড়ানো হতে থাকে, যাতে করে অত্যাচারিত রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে অনীহা প্রকাশ করে কিংবা ওরা ভাসানচরে যেতে সম্পূর্ন ভাবে নিরুসাহিত হয়ে পরে। কিন্তু সরকারও রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে করা সকল সুযোগ সুবিধার কথা খোলাখোলি ভাবে সবার সমনে তোলে ধরেন। যাতে মিয়ানমার থেকে আসা অত্যাচারিত রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হয় এবং রোহিঙ্গাদের মনের সকল দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূর হয়।
ভাসানচরে যেতে রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ভাবে এবং বিভিন্ন রকমের ভয় দেখাতে থাকে। সংবাদপত্রের ভাষ্যমতে এক রোহিঙ্গা নেতাকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা এই বলে হুমকি দেয় যে “তুই কে? ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যেতে উৎসাহিত করতে তোকে কে দায়িত্ব দিয়েছে। ভাসানচর নিয়ে উল্টা পাল্টা করবি না। করলে দুনিয়ায় বেশী দিন ঠাঁই হবে না”। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ভয়ংকর হুমকি ধমকি থেকে এটাই বুঝা যায় যে, মিয়ানমার থেকে অত্যাচারিত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পুণর্বাসনের বিরুদ্ধে একটি মহল বেপরোয়া ভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং এই মহলটি তাদের কার্যকলাপ সফল করার জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা সন্ত্রসীদের ব্যবহার করে যাচ্ছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের যাওয়ার ব্যাপারে প্রচারণা কালে টেকনাফের শামলপুর শিবিরের এক রোহিঙ্গা নেতা এরকম হুমকির সম্মুখিন হন যে, যেখানে তার কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে।
সরকারের সদিচ্ছা থেকে তৈরি করা আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরবাড়ি মজবুত অবকাঠামো দেখে ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গারা খুবই আনন্দিত। এত হুমকি ধমকির পরও সুন্দর আশ্রয়ের আশায় সব ভয় হুমকিকে উপেক্ষা করে শান্তিপ্রিয় রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হন। কক্সবাজার শরণার্থী শিবির থেকে মিয়ানমার থেকে আসা অত্যাচারিতে রোহিঙ্গারা মনের আনন্দে সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বঙ্গপোসাগরের দ্বীপ ভাসানচরে যান। প্রায় এক হাজার ছয়শত বিয়াল্লিশ জন রোহিঙ্গা স্বতঃর্স্ফুত ভাবে নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ভাসানচরে গিয়েছেন।
তাদেরকে একটি চক্র এই বলে ভয় দেখিয়েছিল যে, ভাসনচরে গেলে তাদেরকে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু ভাসানচরে যাওয়ার আগে রোহিঙ্গারা বুঝতেই পারেননি যে, তাদের জন্য সরকার এত সুন্দর মজবুত বসবাসের জন্য আবাস ভূমি তৈরি করে রেখেছেন। অত্যাচারিত রোহিঙ্গারা ভাসানচরে গিয়ে বুঝতে পেরেছেন যে, তারা ভাসানচরে গিয়ে ভুল করেননি। এখানে তাদের জন্য চাষাবাদের জন্য জমিও রাখা হয়েছে। তারা বুঝতে পারছেন কুচক্রী মহলের প্রচারণা ছিল তাদের সুন্দর জীবন যাপনকে কিংবা সরকারের সদিচ্ছাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য। এখানে আরেকটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, ভাসানচরে অত্যাচারিত রোহিঙ্গাদের জন্য কেমন সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে, তা দেখার জন্য চল্লিশজন নেতাদের একটি দল আগে ঘুরে দেখে এসেছেন।
এখানে এটাও বলে রাখা প্রয়োজন ভাসানচরে প্রথম ধাপে যাওয়া রোহিঙ্গারা রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ী ও তাদের জন্য রাখা চাষাবাদের জমি দেখে খুবই আনন্দিত। সকল অপপ্রচার ভয়কে উপেক্ষা করে মিয়ানমার থেকে আসা অত্যাচারিত রোহিঙ্গারা এখন বুঝতে পারছেন যে, এখানে তারা খুবই ভাল থাকবেন এবং এখানে এসে তারা ভুল করেননি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর যেমন অত্যাচার নির্যাতন করে থাকে, তেমনি করে এসব সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা চাঁদাবাজীসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মও করে থাকে। যারা ক্যাম্পের নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করে থাকে, তারা ভালো করেই জানে ভাসানচরে মিয়ানমার থেকে আসা অত্যাচারিত রোহিঙ্গাদেরকে পূণর্বাসন করলে টেকনাফের ক্যাম্পের মত সেখানে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা কোন রকম অপকর্ম করতে পারবে না এবং নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর কোন রকম অত্যাচার নির্যাতনও করতে পারবে না। তাই পূণর্বাসন বিরোধী চক্রটি ভাসানচরে নিরীহ রোহিঙ্গাদের পূণর্বাসনের সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।
একশ্রেণীর লোক প্রচারণা চালাচ্ছে নোয়াখালীর হাতিয়ার বঙ্গপোসাগরের দ্বীপ ভাসানচরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জোর করে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জোর করে ভাসানচরে নেওয়া হচ্ছে না। তারপরও ভাসানচরে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের পূণর্বাসন বিরোধী চক্রটি বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক অপপ্রচার চালাচ্ছে। যাতে সরকারের ভাবমূর্তি দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত এই পূণর্বাসন বিরোধী চক্রটিকে আইনের আওতায় এনে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে শাস্তি দেয়া। সবাই জানে ভাসানচরে চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ ব্যাপক সুযোগ সুবিধা দেখেই মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ভাসানচরে যাচ্ছে।
এখানে আরেকটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদেরকে আমাদের দেশের একশ্রেণীর মানুষরাও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে উৎসাহিত করে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। এখানে আরো একটি কথা বলে রাখা ভালো টাকা পয়সা খরচ করে ভাসানচরকে টাউনশীপ হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে ঘর বাড়ি শুধু নির্যাতিত শরণার্থী হিসাবে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য করা হয়নি। ভাসানচরে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের ছাড়াও বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তা, দূতাবাস কর্মকর্তা, উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের জন্যও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাসহ ঘরবাড়ি বানানো হয়।
দ্বীপটি অর্থাৎ ভাসানচরের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাদের দেশের নৌবাহিনীকে। মিয়ানমার থেকে এর আগেও বিপুল সংখ্যক নিরীহ রোহিঙ্গারা সেই দেশের সেনাবাহিনী দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আমাদের দেশে এসেছিল। বর্তমানে আমাদের দেশে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এগারো লক্ষ। আমরা যদি গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করি তাহলে বুঝতে পারব যে, একটা পক্ষ আমাদের সরকারের শরণার্থী হয়ে আসা নিরীহ রোহিঙ্গাদের পূণর্বাসনের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। একটা পক্ষ চায় সরকার যাতে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পূণর্বাসন করতে না পারে।
চক্রটি এমন সব প্রচারণা চালাচ্ছে, যা দেখে ও শুনে যে কেউ বুঝতে পারবে যে ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্ন ভাবে চাচ্ছে, সরকারের মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পূণর্বাসন প্রক্রিয়াকে যে কোন ভাবেই হোক বানচাল করতে। সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, ষড়যন্ত্রকারী চক্রটিকে আর বাড়তে না দেয়া। কেননা ষড়যন্ত্রকারী চক্রটি কিন্তু বসে নেই। তারা তাদের স্বার্থের জন্য যে কোন মূল্যেই হোক চাইবে সরকারের নিরীহ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাসানচরে পূণর্বাসন প্রক্রিয়াকে যেনতেন ভাবে নস্যাত করে দিতে।
তাই বলছিলাম, আমরা দেশের সাধারণ মানুষ চাইব কোন কুচক্রী মহল যেন কোন ভাবেই সরকারের ভাসানচরে মিয়ানমার থেকে আসা নিরীহ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পূণর্বাসনের ব্যাপারে নাক গলাতে না পারে। এই কুচক্রী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করতে গিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের যদি কঠোর থেকে কঠোরতর হতে হয়, তাহলে তাই হতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিয়ে দেশের স্বার্থে তাদের থামাতে হবে। তা না হলে নিরীহ রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঠিক তেমনি করে আমরা দেশবাসীও বিপদের সম্মুখিন হতে পারি।
লেখক:
আইনজীবী, কবি ও গল্পকার
কালীবাড়ী সড়ক, হবিগঞ্জ।