সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ০৬:০৫ অপরাহ্ন
মোঃ মনিরুজ্জামান:
১৯৮০ সাল। আমি সবে ৬ নং ক্লাস পাশ দিয়ে ৭ নং ক্লাসে পড়ি। বছরের একদম গোড়ার দিকে। তখন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বেশ হাড় কাঁপানো শীত পড়তো। পড়াশুনার এত চাপ তখন ছিলনা। আর অজ পাড়াগায়ের স্কুলে পড়াশুনার চাপ কমই ছিল। স্কুল ব্যাগ ছিলনা। হাতে করে স্কুলে বই নিতাম। এখনকার সময়ের মতো প্রত্যেক বিষয়ের আলাদা ক্লাস ওয়ার্কস খাতা ছিল না। একটি মাত্র খাতায় ক্লাস ওয়ার্ক লিখতাম- নাম ছিল রাফ খাতা। তার আবার ধরন ছিল নিউজপ্রিন্ট, কারন কম দামে কেনা যেত। তাও প্রথমবার পেন্সিলে লেখতাম, পরে কালিতে। উদ্দেশ্য এক পৃষ্ঠায় দুবার লেখা।
মামা বাড়িতে থাকার সুবাদে সঙ্গত কারনেই ডানপিঠে ছিলাম। লেখাপড়ার চাপ না থাকায় স্কুলের পরে বাড়িতে শুধুই খেলা আর দুষ্টুমিই নিত্যকার কাজ ছিল। নিজের সাঙ্গপাঙ্গের সাথে একজোট হয়ে খেজুর রস খাওয়া, আখ মাড়াই দেখা, আখ চিবিয়ে রস খাওয়া। তখন অবশ্য আখের রস বানানো ভ্রাম্যমান মেশিন ছিল না। দাত দিয়ে কামড়িয়ে আখ (কুশোর) খেলে দুটি ফল পেতাম। প্রথমতঃ কয়লায় পরিষ্কার করা দাত আরও উজ্জ্বল হতো। দ্বিতীয়ত রস খাওয়ার স্বাদ ভালভাবে বুঝা যেতো। এখন গ্লাসে আখের রসে স্বাদ আস্বাদন হয় না।
তো ছোট ছোট ২/৩ জন ঘনিষ্ট সাথী/ বন্ধু নিয়ে এপাড়া ওপাড়া ঘুরছি, পাখির বাসা দেখছি, নারকেল গাছে ডাব দেখছি, মাঠে বাধা গরুর লেজ ধরে খামোখাই গরুর রাগ দেখানো উপলব্ধি করছি, আর হাটতে হাটতে বড় মামার নতুন বানানো বাড়ির দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ পুকুর পাড়ের ছোট বরই গাছের দিকে নজর পড়লো।
দেখলাম একটি ঘুঘু ঐ গাছে তার বাসা থেকে উড়ে গেল। আমার নজর পড়তেই সকলকে বললাম ঘুঘুর বাসায় ডিম আছে। চল দেখি। যেমন কথা তেমন কাজ। বরই গাছ ছোট হলে কী হবে গাছে উঠা বেশ কষ্টকর। উঠতে পারছিলাম না। আবার পুকুরে ঐসময় মা, মামীরা মিলে গোসল করার জন্য পুকুর পাড়ে মিষ্টি রোদে পিঠ দিয়ে নানান গল্প মশগুল আর ঠান্ডা পানিতে গোসলের শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছেন। আমাদের দুরন্তপনা দেখে রাগ করলো, ” নাম ওখান থেকে, পাখির বাসা ভাঙ্গবি না। সন্ধ্যায় পাখি বাসায় এসে থাকতে না পারলে তোর অভিশাপ দেবে। তুইও বাসা পাবি না।” অগত্যা নেমে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম, ‘ভালই হলো, সঙ্গে থাকা সাঙ্গ পাঙ্গকে ফাঁকি দেয়া যাবে। কাল সকালে আমি একাই এসে ঘুঘুর ডিম পেড়ে নিবো’।
ঘুঘুর ডিমের চিন্তায় সন্ধ্যায় পড়তেও পারলাম না। মা সরল সহজ গ্রাম্য সংসারী মানুষ, লেখাপড়ার অত খোঁজ রাখেন না। বড় ভাই ঢাকায় বোনের বাসায় থাকেন, পড়াশুনা করেন। বাড়িতে তখন আমরা অবশিষ্ট ৬ ভাইবোন। সকলেই স্কুল পড়ুয়া। মা রাতের রান্না শেষ করে খেতে ডাকেন। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন সকালে মনে হয় একটু আগেই ঘুম ভাঙ্গলো। উঠেই ঘুঘুর ডিমের কথা মনে পড়লো। আর দেরি করলাম না। মামার নতুন বাড়ির পাশের পুকুর পাড়ে একা চলে গেলাম। বরই গাছটি ছিল পুকুরের পশ্চিম পাড়ে, যে পাড়ে মামার বাড়ি।
আমি ঘাট থেকে মুখ ধোয়ার ভান করে এদিক ওদিক চোরের মতো দেখে নিলাম কেউ আছে না-কি। না, কেউ নেই, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আমি বরই গাছে উঠছি। কিন্তু যে পর্যন্ত উঠলাম তাতে হাত ঘুঘুর বাসা পর্যন্ত গেল না। খড় কুটা দিয়ে বানানো ঘুঘুর বাসার নীচের দিকে একটি খড়কুটা দেখলাম। মনে মনে ভাবলাম ওটা ধরে টান দিয়ে বাসাটি একটু নাগালে আনবো। পরে হাত দিয়ে বাসা থেকে ডিম নিব। যেই ভাবা সেই কাজ। সেই ঝুলে থাকা খড়কুটা বাহাতে ধরে টান দিতেই…….
বিশাল এক গোখরা সাপ ঘঘুর ঐ বাসা থেকে ঝপ করে পুকুরে পড়ে গেল। সাতরে পশ্চিম পাড়ের থেকে পূর্ব পাড়ের দিকে চলে গেল। আমার আত্মারাম খাচাছাড়া মনে হলো। আমি এক লাফে গাছ থেকে মাটিতে। দে ভোঁ দৌড়। এক দৌড়ে বাড়ীতে। ভয় পেলাম, হাফাচ্ছিলাম কিন্তু বাড়ির কাউকে কিছু জানায়নি, যেন কিছুই হয়নি।
সেদিনের সেই শিক্ষায় আর কখনো পাখির বাসায় হাত দেইনি, মায়ের কথা অমান্য করায় গোখরা সাপের বিষাক্ত ছোবলের মুখে পড়েছিলাম।
বিষয়টি মনে রেখে চাকুরি জীবনে বহু মানুষের ঘর ঠেকিয়েছি এই বলে যে, ” আমার মা বলতেন পাখির বাসা ভাঙ্গিস না, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সে থাকবে কোথায়, তোকে অভিশাপ দেবে তুইও ঘর পাবি না।”
মানুষ পাখির আবাস ঘর ভাঙ্গে না, আর আপনি আপনার ভাইয়ের ঘর, বোনের ঘর, চাচার ঘর, অন্য মানুষের ঘর ভাঙ্গবেন কেন। তাদের থাকার ব্যবস্থা আপনাদেরই করতে হবে। এমন বুঝানোয় অনেক সময় মানুষের মাঝে বুঝ আসে।
লেখক: ওসি, পিবিআই, নরসিংন্দী।