সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ০৫:৫৫ অপরাহ্ন
মোঃ আলমগীর: জাফর সাহেব প্রতিদিনের মত আজও অফিসে গেলেন। খুব সিনসিয়ার অফিসার। রোজকার রুটিন ওয়ার্ক শুরু করলেন। এখন চা খেতে খেতে কাজ আর একসাথে হয় না। করোনাকালীন অফিসে বাড়তি নিরাপত্তা হিসেবে “এসো নিজে করি” পদ্ধতিতে চলতে হয়। মানে হলো ম্যাসেঞ্জার কাম অফিসার। তিনি গভীর মনযোগ দিয়ে কাজে ডুবে দেয়ার চেষ্টা করছেন। পারছেন না, বার বার বউ ও বাচ্চাদের মুখ ভেসে উঠছে চোখে। অনেক দিন হয় তাদের সাথে দেখা হয় না। বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে আদর করা হয়ে উঠেনি! অনেক দিন তাদের আঙ্গুলে ভর করে আকাশ দেখাতে পারেননি! কখন যে জল গাল বেয়েছে….
বসের কড়া নিষেধ কেউ স্টেশন লিভ করবেন না।লকডাউন যে কোন সময় হতে পারে! নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখবেন।
কথাগুলো যৌক্তিক।কিন্ত বেচারার চরম রাগ হলো, প্রকাশ হলো না। বসকে তো আর রাগ দেখানো যায় না। সময় এখন অন্যরকম, বাতাসও এখন অন্য সুর। প্রাইভেট জব, কর্মী ছাঁটাই,বেতন কমানো,কর্পোরেট ইন্ড্রাস্টিতে বইছে ঝড়ো বাতাস আর এই রকমের ভয় এবং ঝুঁকি নিয়েই জীবন-জীবিকা চলছে আপন গতিতে।
মনে মনে সে বললো আপনারা সবাই তো পরিবারের সাথেই থাকেন। বাসে, রিক্সায়,সিএনজি এমন কি রাইড শেয়ার করে ও আসা যাওয়া করেন।দিন শেষে ফিরেন ঐ পরিবারের কাছেই, আবার খুউউউউব নিরাপত্তা দেখান !!
পরিবারের সাথে থাকতে না পারার কষ্ট আপনারা কি বুঝবেন!!!বেচারা একত্রে থাকতে পারে না বউ কর্মক্ষেত্রে অন্য জেলায়। হঠাৎ পাশের টেবিলের কলিগ, চেহারায় কঠিন এক ভাব নিয়ে ফিস ফিস করে বলছে ভাই কোন শব্দ পাইছেন! ও ভাই!! ভা….ই!!! ও ভাই!
রাজ্যের সব বিরক্তি নিয়ে কিসের শব্দ ভাই প্রতিউত্তর !!? এটা কল কারখানার অফিস নাকি!! মেশিনের শব্দ আসবে!!! আরে না ভাই, বসের টেবিল চাপড়ানার শব্দ, কারে জানি চেঁচা দিচ্ছে।
এআর নতুন কি!! আজ উনি, কাল আপনি, পরশু আমি তরশু অন্য কেউ……! অভ্যেস হয়ে গেছে ,প্রতিদিনই শুনি। মুড ভাল থাকলে যা হয়নি তা হয়েছে আর না থাকলে যা হয়েছে তা হয়নি!! আজব কারবার! আফসোস ! করোনা ও মানুষের চরিত্র বদলাতে পারেনি । কবেই বা বদলাতে পেরেছিলো মানুষের চরিত্র?
মি.জাফরের মেজাজ চরম ! কলিগ কে ধমক দিয়ে বললো,ভাই আপনার আর কোন কাজ নাই!! কে কি করলো আমাকে শুনাতে আসেন কেন? এমনিতেই ছেলেটা পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে, বউ বেলছে এক্স-রে করতে হবে, আপনার এসব প্যানপ্যানানি আমাকে বলতে আসবেন না, এমনি আছি প্যারার মধ্যে… যত্ত সব!! সে বেলুনের মত চুপসে গেলো।
চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে যদিও খারাপ লাগছিলো কিন্তু তা বলা ছাড়া আর উপায় কি! এমনিতেই মন-মেজাজ ঠিক নেই।
স্যার…স্যার….বাসায় যাবেন না?? ম্যাসেঞ্জার..হুম।সকাল গড়িয়ে বিকেল কখন যে হলো ঠের’ই পেলাম না,এবার ঘরে ফেরা,মনে হতেই মনটা বিস্বাদে ভরে গেল, বাসায় গিয়ে কি করবো!? চারদেয়ালের ভিতর কাতরাতে থাকবো প্রিয়জনদের দেখতে না পাওয়ার ব্যাকুলতায়!
প্রিয়জন কে কাছে না পাওয়ার বেদনা, বাচ্চাদের সাথে হৈ-হুল্লোড় না করতে পারার কষ্ট, শেষ কবে ছেলে-মেয়েকে আকাশের তারা দেখিয়েছি তা মনে করতে না পারার তীব্র যন্ত্রনা, বোনাস হিসেবে কোভিড-১৯ এর কল্যাণে পাওয়া গোঁফওয়ালা বুয়ার তকমা তো আছেই।
তারপর অনেক্ষণ বারান্দায় দাড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একরাশ ক্লান্তির ইতি টানবো। আর এই একটা ঘরে বন্দী থেকে খবরের চ্যানেল পাল্টানো ছাড়া কি পেরেছিলাম কবে।
ও জী………ব………ন.. উফ.. এক দীর্ঘশ্বাস. …।
জাফর ভাবে এই যে,ছোট এক অনুজীব করোনা বিশ্বব্যাপি লক্ষাধিক প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে,মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে আমলা-কামলা-ধনি, গরীব-ফকির সকল শ্রেণী পেশার মানব কে একাকার করছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এই বোধশক্তি কি আমাদের কে আদোও স্পর্শ করছে!!?? ফটোল্যাব দিয়ে অবয়ব বৈচিত্রময় করছি, নিজের বিবেক কে কুপ্রভাব থেকে বের করতে পারছি কি!!? এখনো মরে যাওয়া মানুষটার কটূক্তি করতে বাঁধে না আমাদের! এই ক্রান্তিলগ্নে ও আমারা এখনো প্রকাশ করি আমিত্ব!! এমন কি মাস্ক-গ্লাভস পরে ও দানবীয় আঘাত , হত্যা,ধর্ষন, চুরি, ডাকাতি, পরনিন্দা সহ সামাজিক সকল শ্রেণীর নিম্ন কাজগুলো আমরাই করছি!!! এই পৃথিবী সুস্থ হওয়ার আগে এই পৃথিবীর মানুষদের মন, মস্তিষ্ক সুস্থ হওয়া জরুরী।
ভাবুক মন ভাবে আমরা আর কবে মানবিক মানুষ হবো!! আর কতো প্রান নাশ হলে বোধদয় হবে, আর কতো!!? প্রশ্ন থেকেই যায়?¿? স্রষ্টা, দিন গুনছি একটা সুস্থ-সুন্দর পৃথিবী হবে। নতুন স্নিগ্ধ-শান্ত, সোনালী রোদ জানালার ফাঁক দিয়ে মুখে এসে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিবে।স্বাস্থ্যবিধি নিষেধ এর তোয়াক্কা না করেই প্রিয়জনের হাত ধরে বেড়িয়ে পরবো নব উচ্ছ্বাসে।
সেই সুদিনের অপেক্ষার ফরিয়াদ তুমার কাছে….. উদ্বেগ উৎকন্ঠায় জাফর বাসার পথে….।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক, ঢাকা।