শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৬ অপরাহ্ন
সিদ্দিকুর রহমান মাসুম:
আবহমানকাল ধরে মানবদেহের জন্য রক্তদান এবং রক্ত গ্রহণের ব্যবহার চলছে। ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের মহামূল্যবান জীবন ও দেহ সুরক্ষায় রক্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য তরল উপাদান। যেকোনো দুর্ঘটনায় শরীর থেকে রক্ত ঝরে গেলে দেহের অভ্যন্তরে অন্ত্র বা অন্য কোনো অঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হলে অস্ত্রোপচারের জন্য রক্তের খুব প্রয়োজন। প্রসবজনিত অপারেশনের সময় বা বড় ধরনের দুর্ঘটনার মতো নাজুক অবস্থায় রক্ত দেওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। মানবদেহে রক্তশূন্যতার জন্য রক্ত গ্রহণের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি রক্তের চাহিদা পূরণের জন্য রক্ত বিক্রয় বৈধ নয়। তবে বিনা মূল্যে রক্ত না পেলে রোগীর জন্য রক্ত ক্রয় করা বৈধ, কিন্তু এতে বিক্রেতা গুনাহগার হবে।
নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক রোগের ওষুধ আছে। সুতরাং যখন রোগ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা হয়, তখন আল্লাহর হুকুমে রোগী আরোগ্য লাভ করে।’ (মুসলিম)
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বেচ্ছায় রক্তদানে অন্য মানুষের মূল্যবান জানপ্রাণ রক্ষা পায় এবং নিজের জীবনও ঝুঁকিমুক্ত থাকে; তাই রক্তদানের ব্যাপারে ইসলামে কোনো বিধিনিষেধ নেই। অথচ দেশের হাজার হাজার মানুষ প্রতিবছর রক্তের অভাবে মৃত্যুবরণ করছে। রক্তদাতার এক ব্যাগ মূল্যবান রক্তদানের মাধ্যমেই মৃত্যুপথযাত্রী অন্য মানুষের জীবন বাঁচানো যেতে পারে।
কেউ যদি স্বেচ্ছায় রক্ত দান করেন, তাহলে এতে একজন বিপদগ্রস্ত মানুষের বা মুমূর্ষু রোগীর জীবন যেমন বাঁচবে, তেমনি রক্তদাতা ও রক্তগ্রহীতার মধ্যে গড়ে উঠবে রক্তের বন্ধন। স্বেচ্ছায় রক্ত দিলে শুধু অন্যের জীবন বাঁচানো নয়, বরং নিজের জীবনও ঝুঁকিমুক্ত রাখা সম্ভব হবে। বিপন্ন মানুষের মহামূল্যবান জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৩২)
সৎ কর্ম ও নেক আমল করার জন্য আল্লাহর কাছে পরকালে যথাযথ প্রতিদানও মিলবে। যেহেতু তিন মাস অন্তর নিয়মিত রক্ত দান করলে রক্তের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মানুষের রোগ-ব্যাধি ধরা পড়ে, এ জন্য প্রথম অবস্থাতেই আরোগ্য লাভের জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়। একজন সুস্থ-সবল লোকের রক্তদানের বিনিময়ে অন্য একজন অসুস্থ ও মুমূর্ষু ভাইয়ের জীবন রক্ষা পেলে শরিয়ত অনুমোদিত হওয়ায় আগ্রহচিত্তেই তা দেওয়া উচিত।
স্বেচ্ছায় রক্ত দান করলে তা মানুষের অনেক উপকারে আসে। আর এতে অনেক সওয়াব পাওয়া যায়। অন্যদিকে সামর্থ্যবান রক্তদাতাও পরোপকারের মাধ্যমে দৈহিক ও মানসিক দিক দিয়ে ইসলামি মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে সুস্থ, সবল ও নিরাপদ থাকেন। এ জন্য বিশ্বমানবতার উপকার ও জীবন রক্ষার্থে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের কেউ তার অন্য ভাইয়ের উপকার করতে সক্ষম হলে সে যেন তা করে।’ (মুসলিম)
বর্তমান সময়ে স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে গিয়ে মানুষ আনন্দ পাচ্ছে। হেসে হেসে নিজের রক্ত অন্যকে দিতে শিখে ফেলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ শনিবার ফেসবুকে দেখলাম হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার ৮নং খাগাউড়া ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামের তরুণ ফজলুর রহমান। নিজের শরীরের রক্ত স্বেচ্ছায় অন্য জনকে দিতে গিয়ে হাসছে। তাকে অনেকেই কমেন্টে মানবতার উজ্বল নক্ষত্র বলেছেন। আমরা এখন এভাবে সকলেই পারি উজ্বল নক্ষত্র হতে।
আর যারা জীবন-জীবিকা ও অর্থের জন্য যাঁরা রক্ত বিক্রি করে দেন, তাঁদের পেশাদার রক্তদাতা বলে। তাঁরা দু-এক মাস অন্তর বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে রক্ত বিক্রি করে দেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের শরীর অপুষ্ট থাকে, ফলে তাঁদের দেওয়া রক্ত কোনো কাজেই আসে না। পক্ষান্তরে অপেশাদার রক্তদাতারা অর্থের বিনিময়ে নয়, রোগীর প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময় পর পর মানবকল্যাণে স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে থাকেন।
মানবজীবন রক্ষায় স্বেচ্ছায় রক্তদান ইসলাম পরিপন্থী নয়। স্বেচ্ছায় রক্তদান সব ধরনের জনকল্যাণমূলক কাজের শীর্ষে অবস্থান করছে। একজন সুস্থ-সবল মানুষ তিন মাস অন্তর রক্ত দান করতে পারেন, এতে শারীরিক কোনো ক্ষতি হয় না। ১৮ থেকে ৫৫ বছর পর্যন্ত যেকোনো সুস্থ ব্যক্তিই রক্তদান করতে পারবেন। রক্ত দেওয়ার সময় যদি কোনো রকম রোগ-ব্যাধি থাকে এবং কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক চলে, তবে ওই মুহূর্তে অনিরাপদ রক্ত না দেওয়াই ভালো। কাউকে রক্তদানের আগে রক্তদাতার কোনো অসুখ আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য গবেষণাগারে স্ক্রিনিং পরীক্ষা করা হয়। নিরাপদ রক্তের জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ ব্যক্তি অন্তত তিন-চার মাস অন্তর রক্ত দিতে পারেন। স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য পুরুষের ন্যূনতম ওজন ৫০ কেজি বা ১০০ পাউন্ড এবং নারীর ৯৫ পাউন্ড হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের জীবন বাঁচাতে রক্তের বিকল্প নেই। রক্ত বেশি দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। তাই জরুরি মানবিক প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সবার মানসিক প্রস্তুত থাকা উচিত।
আসুন আমরা তরুন ফজলুর রহমানের মত স্বেচ্ছায় রক্ত দেই। রক্তদাতা আমাকে সম্মান করল কিনা সেটা যেন না দেখি। ২৫ বছরের তরুন ফজলুর রহমান অষ্টম বারের মত রক্ত দিয়েছে। আর সে যে পরিবার থেকে বড় হয়েছে ওই পরিবার রক্ত দেয়া তো সোজা চোঁখে দেখতেই পারে না। রক্ত ছেলেটার শরীর ভেঙ্গে যাবে নতুবা রক্তের অভাবে মরে যাবে।
হয়ত তাদের মত অনেকেই জানে না, সুস্থ, সবল, নিরোগ একজন মানুষ প্রতি চার মাস অন্তর রক্ত দিতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রক্তদানের ফলে রক্তদাতার শারীরিক কোনো ক্ষতি হয় না। রক্তের লোহিত কণিকার আয়ু ১২০ দিন। অর্থাৎ আপনি রক্ত দিন বা না দিন ১২০ দিন পর লোহিত কণিকা আপনা আপনিই মরে যায়।
লেখক-
সম্পাদক, করাঙ্গীনিউজ
হবিগঞ্জ।