বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ০৯:১১ পূর্বাহ্ন
এম এ মজিদ: আইন এবং বাস্তবতার যে কত তফাৎ তা প্রায়ই আমরা প্রত্যক্ষ করি। বলতে গেলে তা প্রতিনিয়তই। বিশেষ করে শিশুদের প্রতি আইন ও বাস্তবতার ফারাক বিস্তর। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে হবিগঞ্জ শহরের রাহুল-অর্ণার বিষয়ে শিশু আইনের ব্যাখ্যাসমেত একটি লেখা সুশীল সমাজের মানুষ স্বাভাবিকভাবে নেননি। তীর্যক বাক্যবানে আমি কোনঠাসা ছিলাম। যদিও আমি আইনের কথাই বলেছি।
ঘটনাটি ছিল- শহরের রাস্তায় একটি ছেলে একটি মেয়েকে নির্যাতন করেছে, সেটি ভিডিওতে ধারণ করা হয়েছে। নেট জগতে ভাইরাল হয়েছে। শতশত শিক্ষার্থী প্রতিবাদ মুখর হয়েছে। অফিস ঘেরাও করা হয়েছে। অবশেষে রাহুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন কুখ্যাত দাগী আসামী হিসাবে স্কর্ট দিয়ে আদালতে তুলা হল। তাকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদনও করা হয়েছিল। রাহুল ছিল আইনের দৃষ্টিতে শিশু। আমি শিশু আইন ২০১৩ এর কিছু ধারা তুলে ধরে শুধু শিশুর প্রতি মানবিক হওয়ার কথাই বলেছিলাম। বলেছিলাম, হয় আপনি আইন মানবেন, নতুবা বলবেন আমি আইন মানি না। যদি আইন মানেন, তাহলে শিশুকে আপনি অপরাধী বলতে পারবেন না, তাকে কাঠগড়ায় দাড় করাতে পারবেন না, তাকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করতে পারবেন না। বিচারে যদি একটি শিশু দোষী সাব্যস্থও হয়, তাহলেও আপনি তাকে সাজা প্রাপ্ত আসামী বলতে পারবেন না, বলতে হবে “ আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশু”। বিচার প্রক্রিয়ার কোনো জায়গায় শিশুকে আসামী হিসাবেও উল্লেখ করতে পারবেন না। বলতে হবে “ আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু”।এসবই আইনের কথা। যা বাংলাদেশে বিদ্যমান।
মাঝে মাঝে আমরা আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু (একই অভিযোগে শিশু না হলে বলা হতো আসামী) কে নিয়ে বিপাকে পড়ি। বিদ্যমান আইনটাও আমার কাছে সুস্পষ্ট মনে হয়নি। নতুবা জাকির হোসেন নামের এক শিশুর বিচার কোন আদালতে হবে তা নির্ধারণ করতে ২ বছর সময় লাগার কথা না। সে আরেক ঘটনা। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে হবিগঞ্জে। একটি শিশুর জামিন শুনানী কোন আদালতে হবে তা নির্ধারণ করতেই সময় লেগেছে ৫দিন। সরকারী ছুটিসহ ৭দিন শিশুটিকে কারাগারে থাকতে হয়েছে জামিন শুনানী ব্যতিরেকেই। অথচ প্রাপ্ত বয়স্ক একজনের জামিন শুনানী হয় ২৪ ঘন্টার মধ্যেই। আপনার কাছে ৭দিন হাজত ভোগ হয়তো কিছুই মনে হবে না, কিন্তু যে হাজত ভোগ করেছে, যার সন্তান হাজত ভোগ করেছে, তাদের কান্না অনেকের দরজা পর্যন্ত পৌছুতে অক্ষম। জামিন শুনানী ব্যতিরেখে কেন একটি শিশু হাজত ভোগ করবে সেখানেই আমার প্রশ্ন। হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার সাতপাড়া গ্রামের জাহিদুল ইসলাম আকাশ নামের এক শিশুকে গ্রেফতার করে মাধবপুর থানা পুলিশ। অভিযোগ-দুই পরিবারের হাতাহাতির ঘটনার সময় আকাশ তার চাচীর গলা থেকে দেড় ভরি ওজনের একটি স্বর্ণের চেইন চুরি করে নিয়ে যায়। আপন চাচা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। আকাশের বয়স দেন ১০ বছর। আকাশের বাবা মাকেও আসামী করা হয়। আকাশের মা পরদিনই জামিন আবেদন করে জামিন লাভ করেন। আকাশের বিরুদ্ধে চাচীর কাপড় চুপড় টানা হেছড়া করার মতো শ্লীলতাহানীরও অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগগুলো পড়ে আপনি হাসতেও পারেন। সাধারণত দুই পক্ষের মারামারির সময় যদি কোনো চুরির ঘটনা উল্লেখ করা হয়, অভিযোগগুলো অজামিন যোগ্য হলেও আদালত বাস্তবতার নিরীখে বিশ্লেষন করে জামিন প্রার্থীকে জামিন দেন। আর শ্লীলতাহানীর অভিযোগতো জামিন যোগ্যই। জামিন হওয়া না হওয়া নয়, বিষয়টা অন্য জায়গায়। জাহিদুল ইসলাম আকাশকে বাদী তার মামলায় উল্লেখ করেছেন ১০ বছর, মাধবপুর থানার এসআই মোঃ ইসরাইল হোসেন আসামীকে কোর্টে প্রেরণ সংক্রান্ত ফরওয়ার্ডিং এ জাহিদুল ইসলাম আকাশের বয়স উল্লেখ করেছেন ২০ বছর। প্রশ্ন হচ্ছে জাহিদুল ইসলাম আকাশের জামিন শুনানী হবে কোন আদালতে? মাধবপুরের দায়িত্ব প্রাপ্ত বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মোহাম্মদ নুরুল হুদা চৌধুরীর আদালতে আকাশের জামিন আবেদন করা হয়। আদালত জানালেন জামিন প্রার্থী যদি শিশু হয় তাহলে আমি তার জামিন শুনানী করতে পারব না। অনলাইনে সংযুক্ত জন্ম সনদ পত্র অনুযায়ী আকাশের বয়স গ্রেফতারের দিন ছিল ১৭ বছর ৬মাস ১দিন। আর ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ১৭ বছর ৪ মাস ১৪ দিনের মতো। আদালত জানালেন ওই শিশুর জামিন শুনানী অত্র আদালতে হবে না, তা শুনানী করতে হবে শিশু আদালতে। ইতিমধ্যে আকাশের হাজত ভোগ হয়ে গেছে প্রায় ৫দিন।
১৭ ফেব্রুয়ারী শিশু আদালত-৩ (মাধবপুর) এ আকাশের জামিন শুনানী হল। শিশু আদালত-৩ এর বিজ্ঞ বিচারক মোঃ হালিম উল্লাহ চৌধুরী এবার প্রশ্ন তুললেন, আদালত বয়স সংক্রান্ত বিষয়ে কার তথ্যটি বিশ্বাস করবে? বাদী বলেছে ১০ বছর, গ্রেফতারকারী পুলিশ অফিসার বলেছে ২০ বছর, আপনারা জন্ম সনদ দাখিল করে বলেছেন ১৭ বছর ৬মাস। বরং আপনারা আকাশ এর বয়স নির্ধারনের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে আদালতে একটি দরখাস্ত দেন। আদালত গ্রেফতারকারী পুলিশ অফিসারকে নোটিশ দেবেন। তার বক্তব্য শুনবেন। বয়স নির্ধারনের পর সে শিশু হলেই তার জামিন শুনানী শিশু আদালতে হতে পারে, নতুবা মামলাটি কগনিজেন্স আদালতে পুনরায় প্রেরণ করা হবে, সেখানে জামিন শুনানী করবেন। শিশুটি কিন্তু হাজতে, অথচ জামিন শুনানী করতে সে বিশাল একটি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি । জন্ম সনদ বিশ্বাস না হলে তার মেডিকেল পরীক্ষারও প্রয়োজন হতে পারে। পুলিশ কর্মকর্তা কোর্টে আসবেন, তার জন্য নোটিশ, পুলিশ কর্মকর্তার আবার অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় পূর্ব নির্ধারিত সূচি থাকতে পারে বা তিনি ছুটিতেও থাকতে পারেন, মেডিকেল বোর্ড ঘটনের প্রয়োজন হলে হাজতীকে মেডিকেল বোর্ড এর মুখোমুখি করতে হবে, বোর্ড গঠন, পরীক্ষা নিরীক্ষা, মেডিকেল সার্টিফিকেট ইত্যাদির প্রয়োজন হতে পারে।
একজন জামিন প্রার্থীর জামিন শুনানীর জন্য এত্তোসব বিশাল আয়োজনের সম্ভাব্যতার কথা তার পরিবার যখন আচ করতে পারলো, পরের দৃশ্য উল্লেখ করার মতো নয়। একই সাথে তথ্য ছিল যে, সংশ্লিষ্ট শিশু আদালত এর বিজ্ঞ বিচারক একদিন পর ছুটিতে যেতে পারেন। ভারপ্রাপ্ত কোর্ট অনেক সময় কোনো শুনানীই গ্রহণ করেন না। একটি শিশুর জামিন শুনানী কোন আদালতে হবে তা নির্ধারণ করতেই প্রায় এক সপ্তাহ চলে গেল। শিশুটির ভাগ্য ভাল যে, অনেক কৌশলের পর ১৮ ফেব্র“য়ারী তার জামিন শুনানী হল শিশু হিসাবেই, তার জন্ম সনদ এর মূল কপি দাখিল করা হল, একই সাথে অনলাইন থেকে প্রিন্ট করেও তার জন্ম সনদের কপি দাখিল করা হল। প্রায় ২৫ মিনিট শুনানীর পর হাজত বিবেচনায় শিশু জাহিদুল ইসলাম আকাশের জামিন হল ২ হাজার টাকা বন্ডে। তবে শিশু বিবেচনায় নয়।
লেখকঃ আইনজীবী ও সংবাদকর্মী
হবিগঞ্জ ২১ ফেব্র্রুয়ারী ২০২১